পাকিস্তানের রাজনীতি কোন পথে?

Looks like you've blocked notifications!

পাকিস্তানের ইতিহাসে বিগত কয়েক দিনের উচ্চ রাজনৈতিক নাটকীয়তা সম্পন্ন হয়েছে। ইমরান খান দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা পেল। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায় সাংবিধানিক আধিপত্য, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের জন্য একটি জয় হিসেবে সর্বমহলে চিহ্নিত হয়েছে। ইমরান খানের ক্ষমতা থেকে প্রস্থান পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা, তবে একটি অনিশ্চিত পর্যায় উন্মোচন করেছে।

গত সপ্তাহের অস্থির ঘটনা এবং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটের বহুমাত্রা, যা দেশটিকে কাঁপিয়েছে। বিশ্ববাসীও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। সাবেক ক্ষমতাসীন দলের অগণতান্ত্রিক মনোভাব ও আচরণ পাকিস্তানকে অজানা ভূখণ্ডে নিমজ্জিত করেছে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছে।

পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। কিন্তু তাঁর আমলে পাকিস্তানের অর্থনীতি খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। ইমরান সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা লাখো পাকিস্তানিকে দরিদ্র করেছে। ইমরান ক্ষমতায় আসার বছর ২০১৮ সালে পাকিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ৩১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা ২৯ হাজার ২০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এ সময় ইমরানের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, পাকিস্তান নরওয়ে কিংবা ডেনমার্ক হয়নি। বরং পাকিস্তানিদের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশিদের তুলনায় কমেছে।

শাহবাজ শরিফ দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই। শাহবাজ বলেছেন, জাতীয় সম্প্রীতিই হবে তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। অর্থনীতি চাঙা করে জনগণকে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন তিনি। এমনকি বিরোধী নেতার সঙ্গে আলোচনা করে নতুন মন্ত্রিসভার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। তাঁর কথায় একটি নতুন যুগের সূচনা করবেন তিনি।

এখানে বলে রাখা ভালো, একই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ইমরান খানও। নয়া পাকিস্তান গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইমরান। দেশের তরুণ প্রজন্ম ইমরানের পাশে ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন উদীয়মান শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছিলেন ইমরান খান। তার সমাবেশে লাখো জনতার ঢল ছিল। এত কিছুর পরও কেন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইমরানকে বিদায় নিতে হলো?

বেশির ভাগ বিশ্লেষক ইঙ্গিত করেছেন, পাকিস্তানের ক্ষমতার অভ্যন্তরে ক্রীড়ানক কোন দিকে। কেননা স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কলকাঠি নেড়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইমরানের দলত্যাগ করা একজন সদস্য বলেন, তারাই (সেনাবাহিনী) ইমরান খানকে তৈরি করেছে, তারাই তাঁকে সরিয়েছে। অন্যদিকে ইমরান খান আঙুল তুলেছেন বিদেশি শক্তির দিকে। টুইটে ইমরান বলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়। কিন্তু শাসন পরিবর্তনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আজ আবার পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে। বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে পিটিআই। এরপরই পিটিআই চেয়ারম্যান কথিত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নতুন সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করতে না-পারা পিটিআই যদি ক্ষমতায় আসে, তা হলেও তাদের কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। আর যদি পিএমএল-এন অর্থাৎ শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তাঁকে আরও বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে।

নতুন সরকারের সামনে যেসব সমস্যা প্রকট হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে দুর্বল অর্থনীতি, জঙ্গিবাদ; সর্বোপরি সরকারে জোটসঙ্গীদের মন রক্ষা করা। মূল কথা হলো, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের স্তরে একাধিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

পাকিস্তানে রাজনীতিতে চলমান অস্থিরতা শিগগিরই থামবে না। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতেও। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি রুপির দাম পড়েছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতনের নতুন রেকর্ড হয়েছে। এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছে ১৮৮ রুপি। পাকিস্তানের ইতিহাসে কখনও রুপির দাম এতটা নামতে দেখা যায়নি। যদিও গত তিন বছর থেকেই পাকিস্তানের অর্থনীতির চাকা মন্থর হয়ে পড়েছে। শিল্পখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। রিজার্ভ কমে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

ইমরানের প্রধান প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফ। তাঁকে প্রথমে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পরে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অনেকের সন্দেহ, নওয়াজ অতীতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে নওয়াজের শাস্তির আসল কারণ ছিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ। ক্ষমতায় আসার পর ইমরান গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি ও সেনাবাহিনী একই মতাদর্শের অধিকারী। ইমরানের এমন ঘোষণা নাগরিক সমাজের কর্মীদের উদ্বিগ্ন করে। ইমরানের শাসনামলে তাঁর সরকার ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই—উভয়ের সমালোচনাকারী সাংবাদিক-ভাষ্যকারেরা হামলা-অপহরণের শিকার হন। ইমরানের সরকার ও সেনাবাহিনী উভয়ে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে। কিন্তু কোনো অপরাধীকে কখনওই শনাক্ত করেনি ইমরানের সরকার।

ইমরান বারবার অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বাধীন ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর সরকারের পশ্চিমাবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলেন। অনাস্থা ভোটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে ১০ এপ্রিল রাতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থকেরা। দেশটির অন্তত ৪০টি শহরে বিক্ষোভকারীরা সমবেত হয়েছেন।

ইমরান খান ও তাঁর অনুসারীদেরও এখন কী ভূমিকা হবে, সেটি দেখার বিষয়। এ অবস্থায় পাকিস্তানে গণতন্ত্র যে আরও একবার অনিশ্চয়তায় পড়ল, তা স্পষ্ট। আমরা জানি, একটি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ জঙ্গিবাদের উত্থানসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্ম দেয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর পড়ে এর প্রভাব। তাই আমরা আশা করব, অস্থিরতা কাটিয়ে পাকিস্তান দ্রুত গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়