সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণ
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় রুদ্ধশ্বাস ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট
অন্যান্য দিনের মতো গতকাল ছিল এক সাধারণ দিন। ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৪ টা ৪৫ মিনিট। রাজধানীর সিদ্দিকবাজার। হঠাৎ বিস্ফোরণ। রক্তাক্ত মানুষের ছুটোছুটি। বাঁচার আর্তনাদ। এরপর সবকিছু এলোমেলো। চোখের সামনে বিস্ফোরণ। ঘটনার পর নিজেকে কিছুটা সামলে নিলাম। এরপর রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মনে কেমন যেন এক ভীতি কাজ করছিল।
বারবার চোখে ভাসছে চারদিকে ধোঁয়া। সব মিলিয়ে তাৎক্ষণিক নিজেকে সামলে নিতে হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য দ্রুত অফিসে ঘটনা জানাই। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত মোবাইল ফোনের চার্জ যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ ঘটনাস্থল থেকে সব তথ্য অফিসে দিয়েছি।
বিস্ফোরণের দিন অলৌকিকভাবে আমার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তা যেন নিজের হাতে ধরে আমাকে বাঁচিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রতিদিনের মতো অফিস শেষে কারওয়ান বাজার থেকে বাসে করে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট নামি। বাসার উদ্দেশে সেখান থেকে হেঁটে রওনা দেই। যেই ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটির নিচ দিয়েই প্রতিদিন যাই। সেদিনও ছিলাম। একই পাশে, একই রাস্তায়। বিআরটিসি বাসস্টেশনটা পার হয়ে ফুটপাত দিয়েই হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির কিছুদূর আগে থেমে যাই। সামনে দেখছি দুটি বাস ধীরে চলছে। হয়তো যাত্রী ওঠা-নামা করছে। কয়েকটি রিকশা। ফুটপাতের পাশে ভ্যান থেমে আছে। ভ্যানে কেউ একজন বসে ছিলেন। বাসগুলোর পেছনে সেনাবাহিনীর একটি জিপও জ্যামে আটকে ছিল। আমি ফুটপাত থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দুই থেকে তিন সেকেন্ড আশপাশে তাকাই।
গাড়িগুলোর গতি দেখে ঠিক করি যে পার হবো। হেঁটে রাস্তার ডিভাইডারের কাছাকাছি যেই পৌঁছালাম, তখনি বিকট শব্দ। কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোপুরি হতভম্ব আমি। সব মানুষ উল্টো দিকে ছুটছে। কাঁধের ব্যাগটা মাথায় দিয়ে আমিও দৌড়াচ্ছি। কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারছিলাম না কেন দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ সামনে একজনের ওপর কাচের কিছু একটা পড়েছে দেখলাম। তার কানের পাশটা কেটে গেছে। অনুভব করছি আমার পিঠে-ঘাড়ে ইট-বালু অথবা কাচের টুকরো ঝরে পড়ছে। নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে না আমি বেঁচে আছি না—কি। তখন মনে মনে ভাবছি আর মনে হয় আজ বাসায় যাওয়া হলো না আমার। প্রিয় মানুষ কারো সঙ্গে দেখা হলো না। আমি তখনও স্তব্ধ। পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করলাম। ইন্টারনেট অন ছিল। অফিসের মেসেজ সবসময় আসে। অফিসে জানালাম গুলিস্তানে বিস্ফোরণ। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলাম। বাসায় জানাইনি কারণ মা অনেক দুঃশ্চিন্তা করবেন।
অফিস থেকে তখনি ফোন দিলেন বড় ভাই। খোঁজ নিলেন। সুস্থ আছি জেনে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঘটনা শুনলেন। এরপর ফোন রাখলাম। ছবি তুলে, ভিডিও করে অফিসে পাঠালাম। তখন সামনে দেখলাম রক্তমাখা মানুষের ছোটাছুটি। অজ্ঞাত একজনের সারা গায়ে রক্ত। রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পড়নের শার্টের এক হাতা ছিড়ে গিয়েছে দেখে বোঝায় যাচ্ছে কি ভয়াবহ বিস্ফোরণ। লোকটির পড়নে নিচের অংশে কিছুই ছিল না। বিবস্ত্র ছিলেন, কিন্তু তার সেই খেয়াল নেই। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বলছেন আমাকে বাঁচান। দৌড় দিয়ে একজনের সামনে গিয়ে পড়ে গেলেন আবার রাস্তায়। কেউ তাকে ধরেনি। ততক্ষণে উৎসুক মানুষের ভিড়। সবাই ছবি তোলা আর ভিডিও করায় ব্যস্ত। একজন রিকশাওয়ালাকে বললেন আহত ওই লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। রিকশাওয়ালা না করে দিলেন। কয়েকজন তাকে ধমক দিলেন—কেন নেবে না। রিকশাওয়ালা দেখালেন তিনি নিজেও আহত। তার বাম দিকে কানের পেছন থেকে রক্ত ঝড়ছে। মানুষ সাইড হয়ে দাঁড়ানোর পর চলে গেলেন রিকশাওয়ালা। আরও একটি ভ্যানচালক ভ্যান নিয়ে যাচ্ছেন। তারও বাম হাত বেয়ে রক্ত ঝড়ছে। অনেক মানুষের ভিড়। রক্তমাখা এক এক করে বের হচ্ছে মানুষজন। একজন কোমরের গামছা খুলে নিজের রক্তমাখা মাথায় বাঁধছেন। আর চিৎকার করছেন ‘আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ উৎসুক জনতার মধ্যে কেউ কেউ তখন মানুষকে উদ্ধার শুরু করে দিয়েছে। আশপাশ থেকে ট্রাফিক পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ হাজির। বিস্ফোরণের জায়গায় তখন প্রচুর ধোঁয়া। কেউ সামনে যেতে পারছে না। আহত অবস্থায় যারা ভেতর থেকে বের হচ্ছিল তাদের উদ্ধার কাজ চলছে। আশপাশে ছিটকে থাকা আহতদের উদ্ধার করা হচ্ছে। প্রায় ৭-১০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ আসে। তখন জোড়ালো উদ্ধার কাজ শুরু হয়।
মানুষের এত ভিড় ছিল যে, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। পুলিশ উৎসুক জনতাকে লাঠির ভয় দেখিয়ে দূর করার চেষ্টা করছে। তারপরও ভিড় বাড়তেই থাকে। রাত পর্যন্ত উদ্ধার কাজ চলে। ঘটনার পর প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। তথ্য, ফুটেজ অফিসে দিলাম। এরপর মোবাইলফোনের চার্জ শেষ হওয়ায় চলে গেলাম বাসায়।
লেখক : বার্তাকক্ষ সম্পাদক, এনটিভি অনলাইন।