বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয় ঐক্য ও শক্তির উৎস

Looks like you've blocked notifications!

যুগে যুগে নানা সমাজে এমন সব ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে, যার কার্যকলাপ সে সমাজ ও জাতিকে নবজন্ম দেয়। তেমনই একজন ক্ষণজন্মা, যিনি জন্ম দিয়েছেন স্বাধীন রাষ্ট্রের, তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি ও বাংলাদেশ তথা বাংলার ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছিন্ন সত্তা। নিজের জীবন, নিজের পারিবারিক জীবনকে বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করে ‘সিনসিয়ারিটি অব পারপাজ অ্যান্ড অনেস্টি অব পারপাজ’ দিয়ে এই মহান ব্যক্তিত্ব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ‘বাংলাদেশ’ নামের স্বাধীন দেশটির জন্ম দিয়ে গেছেন।

২.

স্কুল জীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু। তিনি প্রথমে গোপালগঞ্জ ও পরবর্তীকালে কলকাতায় ছাত্রদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি, যাঁর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের ছাত্র, সে সময় (১৯৩৯) একবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী ওই স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তরুণ মুজিব শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর মুজিব কলকাতায় গিয়ে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি আই.এ ও বি.এ পাস করেন। ১৯৪২-৪৭ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব পাকিস্তান আন্দোলনে এবং মুসলিম ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তিনি কখনও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিলেন না। তিনি সব সময় মানবকল্যাণের রাজনীতি করেছেন, সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসতাবিরোধী ছিলেন, তেমনই ছিলেন পরমতসহিষ্ণু। সবার কথা শুনতেন এবং মতামতকে মূল্যায়ন করতেন। ফলে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলভুক্ত হওয়ায় তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের চিন্তা নিজের মধ্যে লালন করতে পেরেছিলেন। দেশভাগের পরে যখন তাঁর লেখাপড়ার ক্ষেত্র কলকাতা থেকে ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সোহরাওয়ার্দী তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দেখো, ওখানে যেন সাম্প্রদায়িক  ঘটনা না ঘটে। তাহলে ভারতের মুসলমানেরা বিপদগ্রস্ত হবে।’ সে-কথা রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি শেখ মুজিব।

৩.

পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রটির জন্মের শুরু থেকে তাঁর রাজনীতির যে ধরন তা দেখে মুজিব ক্রমেই  এই নতুন রাষ্ট্রটির  প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। তবে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে প্রধান সংগঠকদের একজন ছিলেন তিনি। বস্তুত জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদকের তিনটি পদের মধ্যে একটিতে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬৬ সালেই তিনি দলের সভাপতি হন। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবরের আওয়ামী মুসলিম লীগের তৃতীয় কাউন্সিল সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হিসেবে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। দলকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের উদ্যোগেই দলের নাম হতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের পর রাজনীতিতে তাঁর যে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটেছিল, এ ছিল তারই প্রতিফলন।

৪.

আমরা যে বাঙালি, সেই আত্মপরিচয় এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিব ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই ভিত্তি করেছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের প্রত্যাশা এবং মোহভঙ্গ হওয়ার কথা লিখেছেন। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটার পরিচয়ও পাই তাঁর রচনায়। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের প্রক্রিয়ার সাথে ছিলেন। এর আগের বছর তিনি জেলে থেকেই বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই থেকেই শেখ মুজিব ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটতে শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম একটি আদর্শিক ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের মাধ্যমেই রাজনীতিতে এসেছিলেন, কিন্তু পরে নিজেকে পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে অন্যতম একটি ভিত্তি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতিতে নিজে যেমন তৈরি হয়েছিলেন, তিনি ধাপে ধাপে গোটা জাতিকেই এর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে শেখ মুজিব এক সময় বুঝতে পারলেন এবং তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যাতে বাঙালির জন্য আলাদা একটা রাষ্ট্র করা যায়।

৫.

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ব্যাপক সাড়া পেয়ে মুসলিম লীগের বিরোধী একটা দল গঠনের ছয় বছরের মধ্যেই শেখ মুজিব সেই দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়েছিলেন। যখন বঙ্গবন্ধু দেখলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করছে। তখন তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নামেন। কারণ, ধর্মকে ব্যবহার করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন এবং মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তখন ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি বাঙালিদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়কে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর সেই ইশতেহার মানুষ কিন্তু গ্রহণ করেছিল। এর ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানেও ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এভাবেই শেখ মুজিব ধাপে ধাপে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ‘মুসলিম লীগের রাজনীতি করে এসে তিনি কিন্তু রূপান্তরিত হয়ে যান ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে। তিনি জায়গা পেয়ে যান ধর্মনিরপেক্ষতা বা একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাঙালির স্থপতি হিসেবে’, বলেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকগণ। তাঁরা আরও বলেছেন, অথচ ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবকে হত্যার পর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে মূলনীতিগুলোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়।

৬.

রাজনীতির গবেষকগণ মনে করেন, ধর্মের ভিত্তিতে চিন্তা হলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালি জাতির ঐক্য সম্ভব ছিল না। সেই বাস্তবতা, সময়ের প্রয়োজন এবং জনগণ শেখ মুজিবকে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেতা হিসেবে তৈরি করেছিল। এই অঞ্চলের মানুষের ৫৬ ভাগ বাঙালি পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই ন্যায্য হিস্যা লাভের জন্য বাঙালি পরিচয়টা একটা প্রতীক। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে চিন্তা হলে, সেটা হবে আত্মঘাতী। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—এরা বাঙালি হিসেবে বিভক্ত হয়ে গেলে ৫৬ ভাগের হিস্যা তো পাওয়া যাবে না। সে কারণে এই দূরদৃষ্টি এবং বাস্তবতাবোধ তাঁকে ধাবিত করেছে অনিবার্য একটি রাস্তার দিকে। সেই রাস্তাটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা যতটা না তাত্ত্বিক, তার চেয়ে বাস্তব কারণে এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে এসেছে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চার নীতির অন্যতম নীতি হিসাবে এটি স্বীকৃত হয়েছে। বাস্তবতা, সময়, মাটি এবং মানুষ থেকে উঠে আসে এই শিক্ষা, সেই শিক্ষা শেখ মুজিব গ্রহণ করেছিলেন। আর জীবনের মূল্যবান শিক্ষাটা তিনি মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছেন।

৭.

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের গোটা অধ্যায়ে শেখ মুজিবের অনন্য সাধারণ ভাবমূর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা এবং জাতীয় ঐক্য ও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে  ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে শুরু করলেন নতুন অভিযাত্রা। নতুন দেশ গড়ার যাত্রাপথে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, সুচতুরতার সাথে সদ্য স্বাধীন দেশে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করা হয় এবং তারই সুযোগ নিয়ে একদল সংক্ষুব্ধ সেনাসদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের অন্য যেসব সদস্য ধানমণ্ডি  ৩২ নম্বরের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে, মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড  সপরিবারে প্রাণ হারান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস বলছে, আওয়ামী লীগের ভেতরেই খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে একটি চক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত ছিল। এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রুদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বস্তুত বাংলাদেশের ভেতরেই কিছু সংখ্যক লোক ছিল, যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং পুরোপুরি পাকিস্তানপন্থি। তারা অনেকেই পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে ছিল পাকিস্তানের প্রতি অনুরক্ত এক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও তাঁর অনুসারীদের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সেটা এখন প্রমাণ হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড  ছিল এই ষড়যন্ত্রেরই ফল। এই  হত্যাকাণ্ড যে পূর্বপরিকল্পিত তার পরিচয় মেলে নানান তথ্য-উপাত্তে-রচনায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয়নি, তিনি চেতনালোকে সদা জাগ্রত, তিনি ‘চিরঞ্জীব’।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা