বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিপীড়িত মানুষের নেতা

Looks like you've blocked notifications!

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে বর্বরভাবে হত্যা করে ঘাতক দল। তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তাঁকে জাতির মানসপট থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া যাবে। কিন্তু তাই কী হয়! যার হাত ধরে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম, যার হাত ধরে হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার অমিয়সুধা পান করেছে বাঙালি জাতি, ষড়যন্ত্র কী তাঁর বিনাশ ঘটাতে পারে। আজ বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা হিসেবে স্বীকৃত। তাই শোককে শক্তিতে পরিণত করে, দামাল বাঙালি আজ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণের মিশনে মগ্ন। 

ষাটের দশকের প্রথম দিকের আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল বাপক। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক হরতালে আদমজী-ডেমরা-তেজগাঁও-টঙ্গী অঞ্চলের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। এটা ছিল ষাটের দশকের শুরু থেকেই শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সচেতন উদ্যোগের ফল। ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানও সংঘটিত হতে পেরেছিল শ্রমিকরা বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে ঢাকার রাজপথে চলে আসার কারণে। ছাত্র ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও কর্মচারীদের সঙ্গে অভিন্ন কণ্ঠে তারা দাবি তুলে, ‘আগরতলা মামলা তুলে নাও, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’।

বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল নির্বাচন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও আমরা তা দেখেছি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকেও তিনি ছয় দফা ইস্যুতে গণভোট হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জনসমর্থন সংগঠিত করার জন্য তিনি ছুটে গেছেন শহর-বন্দর-গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে। তিনি যে ‘বাংলাদেশ’ চাইছেন, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এমন ঘোষণা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’, সেটা তাঁর চেয়ে আর ভালো কেই-বা জানতেন। কিন্তু ততদিনে তো নিশ্চিত হয়ে গেছেন- বাঙালি স্বাধিকার চায়, স্বাধীনতা চায়। কেউ তাঁকে দাবায়ে রাখতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম কৌশল ছিল সর্বোচ্চ জনসম্পৃক্ততা। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি বা যুগ্ম সম্পাদক হন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই সারা দেশে জনসংযোগ চালানোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ‘পোস্টার ইমেজে’ পরিণত হন তিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সহকর্মীদের মাধ্যমে যথাযথ দিক-নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন। এমনকি জেলে থেকেও আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণার জন্য গ্রহণ করেন অনশন কর্মসূচি। এই আন্দোলন পরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়- শেখ মুজিব এমনটিই চেয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে তিনি বারবার ছুটে গেছেন। কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, জনসমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। এর সুফল মিলেছে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিকে গোলাম করে রাখার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের প্রবল ছাত্র-গণআন্দোলন সেটা নস্যাৎ করে দেয়। এটাই তরুণ বয়সে শেখ মুজিবুর রহমানের গণসংযোগের তেলেসমাতি। 

এরপর, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু হলো, বিন্দুমাত্র দ্বিধায় পড়েননি জাতির পিতা। ৩ মার্চের নির্ধারিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিত ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে। বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত, সেটা তিনি জানিয়ে দেন। ১ মার্চ দুপুর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই একমাত্র কার্যকরী নির্দেশ হিসেবে পালিত হতে শুরু হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত বিশাল সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন সত্যাগ্রহ, অসহযোগ। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলবে’।

৭ মার্চ রেসকোর্সের সমাবেশ থেকে কার্যত স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই আদালতের বিচারক, সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বেশিরভাগ বাঙালি সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশন কর্মী থেকে সর্বস্তরের জনতা যাবতীয় নির্দেশনা গ্রহণ করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি  ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িকে কেন্দ্র করে পরিচালিত ‘বিকল্প সরকারের কাছ থেকে’। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আইনগত বৈধতা ছিল। কারণ জনগণ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকে কেবল ‘বাংলাদেশ’ নয়, গোটা পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করেছিল।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরু করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসন- বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দেন পৃথক পৃথক বিশেষজ্ঞ দলকে।

পরবর্তীতে এই পথ ধরেই স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর দেখানো গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ অনুসরণ করেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি জান্তাদের হাতে গ্রেপ্তার হলে, ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেন তারা। এরপর একটি নিয়মতান্ত্রিক কমান্ড স্থাপন করে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

লেখক : পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ