পহেলা বৈশাখ

বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা

Looks like you've blocked notifications!
মঙ্গল শোভাযাত্রা, বঙ্গাব্দ ১৪২৯। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সুধামিশ্রিত অনুভবকে সঙ্গী করে কৃষ্ণচূড়ার লাল আভায় প্রীত হলো আজকের যে মুখাবয়ব, কাল হয়তো বেদনার অন্ধকারে আবৃত ছিল। আমাদের সঙ্গী হয়ে আছে নানা দুঃখবোধ, আছে শত সহস্র গ্লানি। তারপরও করোনা অতিমারির ধকল ও সকল অন্ধকারের কালিমা দূরীভূত হয়ে আলোকদিশারি নতুন সময়কে ধারণ করে বাংলাদেশে আবার নামল নতুন দিন।

শুভ নববর্ষ ১৪২৯।

স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তিতে আমাদের প্রাণ হোক কোমল। মনজুড়ে চলুক রসের আবেশরাশির মহোৎসব। মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে আবার শুনিয়ে যাক আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সত্য ও সুন্দরের গান...

ধরণী’পর ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা

ফুলপল্লব-গীতগন্ধ-সুন্দর-বরনে॥

বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,

করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে॥

আজ পরিশ্রমী বণিকের ঘরে আসুক শুভ হালখাতা। মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রার্থনা হোক সবার সবিশেষ সুখ।

সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক কিংবা মোঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে বাংলা নববর্ষ পালনের যে সূচনা শুরুর মতো আজকেও তা কিষান-কিষানির প্লেটে শীতল পান্তাভাত। নগরকেন্দ্রিক বাবুদের প্লেটে এক দিনের যেই পান্তার আদিখ্যেতা প্রান্তিকজনের তা রোজকার খোরাক। ওই হররোজ খোরাকের আনন্দই আজকের পহেলা বৈশাখের সুখ ও সমৃদ্ধির আতিশয্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কো ঘোষিত ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’। বিশ্বমানুষ হিসেবেও তাই পহেলা বৈশাখকে খারিজ করে দেওয়ার আর কোনও সুযোগ নেই।

কারও কানকথায় নিজেদের বোধ বিসর্জন না দিয়ে, দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে, নিজেদের বাঙালিয়ানার আসল পরিচয় না ভুলে সদ্ভাব, সম্প্রীতি, ঔদার্য, মহত্ত্ব দিয়ে নতুন দিনটাকে সকলের সানন্দ সহাবস্থানে উদযাপন করতে পারি।

সর্বজনবিদিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের অনুসরণে পহেলা জানুয়ারি কিংবা নির্দিষ্ট কোনও জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সন-তারিখে নববর্ষ কিংবা নওরোজে অনাগত দিনে সবার শান্তি কামনাই স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনের সারকথা। সমাজবদ্ধ মানুষের মঙ্গল কামনাই সবার প্রার্থনা। সুখ ও সৌভাগ্যের প্রতীক ভাবনায় পালন করে থাকে নানান রিচুয়াল বা কৃত্য। তবে এই কৃত্যের অগ্রভাগে থাকে ‘শস্যবন্দনা ও জীবনধারণ’।

পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব নববর্ষ আছে। উদযাপন ভাবনাও তাই যার যার মতো।

সব ঝেড়েঝুড়ে এই নববর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা সবাই সবাইকে খাওয়াব, ‘ভেতো’ বাঙালির নাম রোশনাই করব, মিষ্টান্ন, রসগোল্লা আর পিঠেপুলিতে সাজাব বন্ধু, আত্মীয় ও শুভান্যুধায়ীর হার্দিক পাত। সাথে গীত হোক, বাদন হোক, আর হোক দিল উজাড় করা আড্ডা। উৎসবটা হোক সবার।

বাঙালি সংস্কৃতির বেলায় বাতিলের খাতা না খুলে আজ আমরা বরং এই প্রার্থনাটুক করি, আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে দেশটাকে যেন ভালোবাসি। মানুষের প্রতি প্রেমপূর্ণ মমত্ববোধ পোষণ করি। লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ যেন নিয়ন্ত্রণে রাখি। এই প্রতীতি যেন মগজে রাখি যে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, নারীর প্রতি সহিংসতা, মাদকের ছড়াছড়ি, খাদ্যে বা ওষুধে ভেজাল দেওয়া, মুনাফাখোরী, কালোবাজারি, সিন্ডিকেটগিরি, আইন অমান্যকারীদের অবৈধ সুযোগ দিয়ে চাঁদাবাজি করা নীতির প্রতি অবিচার।

আমাদের নতুন দিনের আরাধ্য এটাই, একাত্তরে পাওয়া মহান সংবিধানের অনুবর্তী থেকে এই দেশ হোক ধর্মনিরপেক্ষতায় অটল, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যবাদী সমাজতন্ত্রে স্থির, গণতান্ত্রিক মানবাধিকারে নিবেদিতপ্রাণ ও সরল জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত। শান্তির ধর্মের সহাবস্থানে দেশটা তাঁর লোকজ সাংস্কৃতিক পরিচয় সবার ওপরে তুলে ধরুক। বাউলিয়ানার সহজিয়া পন্থা প্রমোট করুক। এখানে বাজুক জারি সারি ভাটিয়ালির অমৃত সুরলহরি। সাদাসিধে ভাবনায় আবার কথা কয়ে উঠুক লালন ফকির, হাসন রাজা, রাধা রমণ, শাহ আব্দুল করিমেরা।

আজ কবিগুরুর গান বাজুক এখানে সেখানে...

এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো,

তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥

লেখক : সাংবাদিক