বাঙালির নিরুপমা মিষ্টি মেয়ে কবরী

Looks like you've blocked notifications!

এই সময় আমাদের যেন আর কোনো ব্রত নেই, কর্ম নেই, নেই কোনো স্বপ্ন। ব্রত এখন একটাই সময়ে-অসময়ে কঠিন সত্য সেই অমোঘ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।

মহাপ্রকৃতি নির্ধারিত সেই ব্রতে এবার নাম লেখালেন অনন্য ও অসাধারণ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সারাহ বেগম কবরী। একাত্তর বর্ষ ধরে যিনি বাঙালিয়ানা নামে রঙিন ঘুড়ির নাটাই বহন করে চলেছিলেন সশ্রম সযত্নে।

কত অভিধায় না অভিহিত করা যায় কবরীকে। চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে। ডটার অব বাংলা মুভি‌। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নিরুপমা।

বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণকালের এই প্রিন্সেস আমাদের বোধ ও মননজুড়ে কতটা জড়িয়ে আছেন এখনকার টিকটক-ঠিকঠক অস্থির প্রজন্ম সেটা অনুধাবন করতে পারবে না।

কবরী ও তাঁর সতীর্থ শিল্পীদের হৃদয়স্পর্শী ও আবেগঘন অভিনয় দেখতে দেখতে বাল্যকালে আমরা জীবনবোধ শিখেছি। ম্যানার শিখেছি। শিখেছি সভ্য সমাজে চলনসই অ্যাটিচ্যুড। সেই মানুষটি মহাকালের অবিনশ্বরতা তাঁর চিরায়ত পদচিহ্ন আঁকলেন।

গভীর শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রিয় শিল্পী। আপনার মহত্তম শিল্পসুষমা আমাদের দেশজ সংস্কৃতিতে আলোকময় দিশারি হয়ে রবে।

সেই ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে শুরু। তারপর ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরী’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘রংবাজ’, ‘সুজন সখী’, ‘আগন্তুক’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’সহ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।

১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন মিনা পাল। তারপর জীবনের অনিবার্য নানা বাঁকবদলে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি সারাহ বেগম কবরী।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সহযোগে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান এই শিল্পী। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। যোগ দেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এভাবে একটা দেশের জন্মগাথায় নিজের নামটি সগৌরবে গেঁথে রাখেন।

২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি মুভি নির্মাণ করেন কবরী‌। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। এক জোড়া নতুন জুটি নিয়ে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে অপর একটি মুভি নির্মাণ করেছেন বর্ষীয়ান এই নির্মাতা। যদিও ছবিটি এডিটিং প্যানেলে রেখেই আড়াল হয়ে গেলেন আমাদের এই সচল-সজীব চলচ্চিত্রকন্যা। এ ছাড়া নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ নামে আরেকটি ছবি।

সব স্বপ্নকে কালচক্রে তুলে রেখে বড় অসময়ে চুপকথাকেই আপন করে নিলেন এই জাতশিল্পী।

২০০৮ সালে জনগণের ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হওয়া কবরী আজন্মই মহাবিষণ্ণ এক দুঃখবোধকে লালন করে গেছেন। গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারেও লালিত সেই বেদনকথা লুকাননি। তিনি বলতেন, ‘আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল, জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না। সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি। এটাই হয়তো মানুষের জীবন।’

কবরীর আত্মকথন ‘স্মৃতিটুকু থাক পড়ে মুগ্ধ হয়ে লোকশিল্পী মোস্তাফা জামান আব্বাসী ‘কবরীর আত্মস্মৃতি শিরোনামে লেখা নিবন্ধে জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর কথা তিনি নিজেই বলেছেন। ফ্রক পরা কিশোরী মিনা পালই আমাদের জীবনস্মৃতিতে একটি উজ্জ্বল তারকা। তাঁর অভিনয় যে একবার দেখেছে, চিনে নিয়েছে বাঙালির রুচির শ্রেষ্ঠ একটি স্থিরচিত্রকে, যিনি চলচ্চিত্রে তাঁর স্থায়ী স্বাক্ষর রেখে গেছেন।’

ভয়াল কোভিডের এই অতিমারির কালে মৃত্যুকে আমরা আলিঙ্গন করে চলেছি একান্তে বন্ধুরূপে, সখারূপে। ক্ষণকাল মনে হয় এই মরণ অতি নিচ, অনুদার, সর্বগ্রাসী এবং স্বার্থপর। যেমনটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন-শেষের উপলব্ধি। সংশয়গ্রস্ত দার্শনিক চিন্তায় পরিপূর্ণ, অস্পষ্ট, দ্বিধাযুক্ত এবং পরিশ্রান্ত পথিকের ন্যায় বেশ খানিকটা উদাসী। মরণের এই বৈরাগ্য সাধন প্রাণীর জীবনে অতিশয় অনিবার্য।

মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেমনটা এ কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেন, ‘অর্জুন, তুমি-আমি সহস্র বছর ধরে জন্ম-মৃত্যুর এই ধারাবাহিক শেকলের মাঝে আছি, পার্থক্য হলো, তুমি সেটা স্মরণ করতে পারো না, আমি পারি।’

সেই মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক। জীবনের সব ভ্রান্তির অবসান, সব তর্কের শেষ, সব কামনার পূর্ণ তৃপ্তি। সারাহ বেগম কবরী আপনার এখনকার অসীম নিস্তব্ধ দেশের চিররাত্রিরা অনন্ত সান্ত্বনা পাক। আর আমরা ‘সুতরাং’ থেকে গাইব, ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাকা জানি/ তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা।’ ‘কত যে মিনতি’ ছবির ‘তুমি সাত সাগরের ওপার হতে আমায় ডেকেছ।’ ‘সুজন সখী’র ‘আহা গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়।’ কিংবা ‘সারেং বউ’ মুভির সেই বিখ্যাত গান ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া।’

বাংলা সংস্কৃতিতে যে দীপশিখা জ্বালিয়ে গেলেন কবরী, সেই বাতিঘর উত্তরপ্রজন্মকে নিশ্চিতই পথনির্দেশ করে যাবে। ইতিহাসের আলোকবর্তিকায় আঁকা হয়ে থাকবে ‘কবরী প্রবণতা’ বলে বিশেষ শিল্পস্মারক। আমরা সেই কবরী ট্রেন্ডের বন্দনা করব, জয়গান করব।

আমাদের এই জয়িতা ধ্রুবতারার জন্য রাবীন্দ্রিক নৈবেদ্যটুকু লেখা থাক—

নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।

মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা॥

বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,

সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা॥

রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির-আশা,

শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা।

সংসারের সুখে দুখে চলিয়া যেয়ো হাসিমুখে,

ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা॥

লেখক : সাংবাদিক