বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আবদুল গাফফার চৌধুরী

Looks like you've blocked notifications!

আবদুল গাফফার চৌধুরী—বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অতিপরিচিত, অতিপ্রিয় একটি নাম। এ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অলিখিত ইতিহাস, অনেক ঐতিহাসিক গৌরবগাথা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি?’ বাঙালির এই চিরকালীন শোক স্তোত্রের রচয়িতা, বাঙালি রাষ্ট্রসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ, মাতৃভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের স্মৃতি জড়ানো একুশের গানের রচয়িতা, দেশবরেণ্য সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। গত ১৯ মে লন্ডনের একটি হাসপাতালে প্রয়াত হন তিনি। তাঁর মহাপ্রয়াণ পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে দিয়ে গেল প্রগতিশীল চেতনার উত্তরাধিকার বহনের অনিবার্য দায়িত্ব। সন্দেহ নেই, তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। অবিস্মরণীয় সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়।

বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রভাতফেরির ‘সিগনেচার টিউন’ হয়ে ওঠা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির অমর স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরীর পরিচয় অবশ্য শুধু সাহিত্য, সাংবাদিকতার জগতেই নয়। কলাম হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও ছিল অতুলনীয়। তাঁর প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা সমাজের অগ্রগতি সাধনে সহায়ক হয়েছে। তাঁর লেখা কলামগুলো অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র তৈরি করতে পারত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও অবদান রয়েছে তাঁর। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’র প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি, ভাষা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর।

বর্তমান প্রজন্ম হয়তো আবদুল গাফফার চৌধুরীকে জানেন একজন কলাম লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, জেল খেটেছেন। আবার ভাষা শহীদদের স্মরণে লিখেছেন অমর চরণ, বাঙালির আপন গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি/ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি’। এই গানের কথা ও সুর এতটাই মানুষকে আন্দোলিত করেছে যে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। অমর গানটি প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন-এ, ১৯৫৩ সালে। এর আগেই গাজীউল হক ও আবদুল লতিফ একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণে দুটি গান লিখেছিলেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে শুধু শহীদদের প্রতি শোকগাথা বা আহাজারি নয়, এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদ্দীপ্ত আহ্বান। এই গান কেবল আবদুল গাফফার চৌধুরীর কিংবা সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালি চেতনাকেও করেছে তীক্ষ্ম ও শানিত।

আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের জন্য রেখে গেলেন অসামান্য অনেক স্মৃতি, অনন্য অবদান। তাঁর একুশের অমর গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর যে কবিতা পরবর্তী সময়ে সুরারোপিত হয়ে গান হিসেবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির অনিবার্য অনুষঙ্গে দেশ-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, এই ঘটনা ছিল সেই কবিতাকে ঘিরে। একুশের এই গান আজ আর কেবল বাংলাদেশের গান নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকোর এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশ্বের ১৯৩টি রাষ্ট্রে গাওয়া হয় এই গানটি। বর্তমানে এই গানটি ইংরেজি, হিন্দি, মালয়, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ অসংখ্য ভাষায় গাওয়া হয়। যত দিন প্রভাতফেরি হবে, তত দিন এই গান গাইতে হবে। এমন গৌরবের কথা নিশ্চিত জেনেই গেছেন তিনি। ক’জনের এমন ক্ষমতা আর এমন সৌভাগ্য হয়! উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, আবদুল গাফফার চৌধুরী অমর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর গান রচনা করেছেন। এর মধ্যে দুটি গানের কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। একটি ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/ আমি কি ভুলিতে পারি/ একুশে ফেব্রুয়ারি,’ আরেকটি, ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/ দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।.../ এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’

এবার একটু পিছু ফিরে স্মৃতিচিত্র খুঁজে দেখা যাক। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ভাইয়ের, সন্তানের রক্তমাখা সেই দুপুর কোনো রক্তচক্ষুর ভয়ে এক দিনের জন্যও ভুলবে না বাঙালি জাতি। শহীদ রফিকের রক্তমাখা শরীর দেখে এই সাহসী উচ্চারণটি প্রথম করেছিলেন এক তরুণ। কবিতার খাতায় লিখেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে যে গানটি বাঙালির চেতনাকে নতুন করে জাগায়, ভাষা নিয়ে তার আবেগকে আরেকবার বাঙ্ময় করে, ভাষাশহীদদের জন্য আমাদের ভালোবাসাকে এর সমৃদ্ধ বাণী এবং অতুলনীয় সুরে প্রকাশ করে, সেই গানটির রচয়িতাই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেদিনের ১৭-১৮ বছর বয়সী তরুণ কবি আবদুল গাফফার চৌধুরী পরে হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাসে চির গৌরবের এক নাম। আমৃত্যু সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অধিকার রক্ষার মহৎপ্রাণ কলমযোদ্ধা ছিলেন তিনি। বাঙালির নিরন্তর সংগ্রামশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বাঙালি জীবনের প্রোজ্জ্বল এক আলোক মশাল ছিলেন। যদি আর কিছুও না লিখতেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... এই একটি গান রচনার জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকতেন। লেখক, সাংবাদিক আর অন্যসব পরিচয়কে ছাপিয়ে তাঁর কবিরূপকে অমর করেছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতা। এই কবিতাই একদিন কালজয়ী, হৃদয়-মন মাতানো গান হলো শহীদ আলতাফ মাহমুদের অমর সুরে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক ঘটনার সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল গাফফার চৌধুরী এ গানটি প্রথমে কবিতা আকারে লেখেন। গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে সুরারোপ করেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি সর্বত্র গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহারের পর সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ইতোমধ্যে গানটি সুইডিশ ও জাপানিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করে। বাঙালির শোকের প্রভাতফেরির এ গান যত দিন বাঙালি থাকবে, তত দিন অমর হয়ে রইবে। শুধু ফেব্রুয়ারি কেন, সারা বছরই যখন বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ ওঠে, বাংলা ভাষাকে নানা বিচ্যুতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ভাষা শহীদদের আত্মদানের বিষয়টি বাঙালি স্মরণ করে, সে মনে আনে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি’। যত দিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে, তার চর্চা হবে, তত দিন গানটিও থাকবে। একুশের গানটি তো তাঁকে একটা বিশাল উচ্চতায় নিয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু তাঁর যে অনেক গল্প-উপন্যাস-কিশোর সাহিত্যের বই আছে, সে কথাটা যেন ওই অবস্থানের কারণে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। সমালোচকদের মতে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘নাম না জানা ভোর’, শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ ‘সম্রাটের ছবি’। ১৯৭৫-এর আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে লিখেছেন নাটক, পরে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘সর্বনাশের আশায়’। অসংখ্য পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি, ইউনেস্কো, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, মানিক মিয়া স্মৃতি পুরস্কারসহ আরও দেশি-বিদেশি পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার জনগণের ভালোবাসা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের অমর স্রষ্টা হিসেবেই তিনি সকল বাঙালির হৃদয়ে চির অমর হয়ে থাকবেন। তাঁরই প্রিয় বন্ধু সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাঙালি জাগরণের শ্রেষ্ঠ গানটি তিনি কীভাবে লিখতে পেরেছিলেন। বাঙালি মানসে তিনি আজীবন শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে থাকবেন।’ গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায়, বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, এই গানটিও তত দিন থাকবে। তাঁর ভাষায়, ‘এটি শুধু গান হিসেবেই ব্যবহার করেনি, এটি একটি আদর্শিক দিক উন্মোচন করেছিল। তখন প্রতিঘাত করার প্রয়োজন ছিল, সেটা গানের মাধ্যমে উনি মিটিয়েছেন।’

আশিতম জন্মবার্ষিকী পালনের কয়েক দিন পর ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘আমি সকলের কাছে ঋণী’ শিরোনামে একটি আত্মকথন লিখেছিলেন। অকপটে জানিয়েছিলেন, বায়ান্নর ভাষা-সংগ্রামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেটি যে কালজয়ী গান হয়েছে সে কৃতিত্ব আমার নয়। জাতীয় জীবনের একটি পবিত্র শোক আমার কিশোর বয়সের কলমে আকস্মিকভাবে ভাষা পেয়েছিল বলেই এই গানের এই অমরত্ব। গানটিকে সেই অমরত্ব দানের সর্বাধিক কৃতিত্ব শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের। একাত্তরে পাকিস্তানের হানাদারদের হাতে যিনি আত্মদান করেছেন। আমার আশিতম জন্মবার্ষিকীতে এবার দেশে যে সম্মান আমাকে দেখানো হয়েছে, তা এই অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদের প্রাপ্য। আমি বাংলা একাডেমির সংবর্ধনা সভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম তাঁকে স্মরণ করেছি। নজরুল বিশেষজ্ঞ  অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকে রফিকুল ইসলাম আমার বন্ধু। তার চাইতেও বড় কথা, তিনি একজন গোলআলু পণ্ডিত নন; নীতিনিষ্ঠ পণ্ডিত এবং গবেষক। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের সাংস্কৃতিক মুক্তির এমন কোনো আন্দোলন নেই, যার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না। অমর একুশের যে গানটির জন্য আজ আমার এত সম্মাননা, কবিতা থেকে একে একটি গানে পরিণত করার ব্যাপারে রফিকুল ইসলামের অবদান অনন্য। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির অপরাহ্নে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের বারান্দার ফ্লোরে একজন ভাষাশহীদের রক্তাক্ত লাশ দেখে আমার মনে গুনগুনিয়ে উঠেছিল একটি কবিতার লাইন :‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ কবিতাটি দীর্ঘ। শেষ করতে লেগেছিল দিন চারেক। এ সময় ভাষা আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের নেতৃত্বে গেন্ডারিয়ার এক বাগানে একটি গোপন সভা হয়। সেই বৈঠক থেকে একটি গোপন ইশতাহার প্রকাশ করা হয়। এটিই ভাষা আন্দোলনে গুলি বর্ষিত হওয়ার পর প্রথম ইশতাহার। দ্বিতীয় ইশতাহারটি প্রকাশ করেছিলেন প্রয়াত কবি হাসান হাফিজুর রহমান। দুটি ইশতেহারই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের উল্টো দিকের ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। এই প্রেসটি থেকেই তখন ছাত্র আন্দোলন ও গণ আন্দোলনের সকল ইশতাহার বইপত্র ছাপা হতো। প্রেসটি এখনও আছে কি না আমার জানা নেই। গেন্ডারিয়ার মাঠের সভা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইশতেহারে আমার আরেক প্রয়াত বন্ধু আহমদ হোসেনের উদ্যোগে আমার একুশের কবিতাটি প্রকাশিত হয়। সেটি চোখে পড়ে ড. রফিকুল ইসলামের (তখন তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) এবং তিনি সেটি তার ছোট ভাই আতিকুল ইসলামকে দেন। আতিকুল ইসলাম ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি গান খুঁজছিলেন। আমার কবিতাটি তিনি সুরকার আবদুল লতিফকে দেন। তিনি তাতে প্রথম সুরারোপ করেন। পরে সুর দেন সুরকার আলতাফ মাহমুদ। তার দেওয়া সুরেই একুশের প্রভাত ফেরিতে গানটি গাওয়া শুরু হয়। এখন আতিক, লতিফ ভাই এবং আলতাফ মাহমুদ এই তিন সংগীত সাধকই প্রয়াত। রফিকুল ইসলাম আরও একটি বড় কাজ করেছেন। পুলিশের নজর এড়িয়ে তিনি ভাষাশহীদ রফিকের লাশের ছবি তুলেছিলেন। পুলিশের গুলিতে রফিকের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। আমি এই মৃতদেহটি দেখেই একুশের গানটি লিখেছিলাম। আমার ধারণা ছিল আরেক ভাষা শহীদ বরকতের মৃতদেহ দেখে সম্ভবত আমি কবিতাটি লিখেছি। রফিকুল ইসলামই আমার ভুল ভাঙিয়ে দেন। তিনিই আমাকে জানান, মৃতদেহটি বরকতের নয়, রফিকের।’

আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত একুশের গান নিয়ে অক্ষয় স্মৃতিকথা বলেছেন নিজেও, লিখেছেন বন্ধুরাও। সকলের ভাষ্যমতে, ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের বিভিন্ন কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি। বলা বাহুল্য, কর্তৃপক্ষ তা সুনজরে দেখছে না। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও এ নিয়ে উৎসাহ-উত্তেজনা। তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের নেতারা স্থির করলেন, কলেজ প্রাঙ্গণেই একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করবেন নিজেরাই। আর একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এ উপলক্ষে; ৩ এপ্রিল, ব্রিটানিয়া হলে। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানাল, শহীদ মিনার স্থাপনে অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এটা সরকারি কলেজ। তাঁরা অবশ্য বিনা অনুমোদনেই ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা স্থানীয়ভাবে ইট-সুরকি-সিমেন্ট জোগাড় করে হাতে হাতে একটি ছোট শহীদ মিনার বানিয়ে ফেললেন। ঢাকা কলেজ তখন সিদ্দিকবাজারে একটি ভাড়াটে বাড়িতে অবস্থিত। এলাকার সমাজপতি মতি সরদার। তাঁর স্থাপনা থেকে যথেষ্ট সহায়তা ও সহযোগিতা পেলেন। মিনার উদ্বোধনের সময় কলেজেরই ছাত্র সংগীতশিল্পী আতিকুর রহমান একটি দেশাত্মবোধক গান গাইলেন। দুটো কবিতা থেকে অংশবিশেষ পাঠ করা হলো। একটি হলো আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’; আরেকটি ছিল হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আম্মা তার নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর’। ঘণ্টা দুই পর কলেজের দারোয়ান এবং পিয়নেরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসে মিনারটি ভেঙে দিল। সকলে স্থির করলেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি খুব জোরেশোরে বৃহদাকারে করা হবে। ব্রিটানিয়া হল বলে একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল রমনায়, সেখানে প্রায়শ ইংরেজি ছবি প্রদর্শিত হতো। তবে মাঝে মাঝে সেখানে অনুমতি নিয়ে অন্যবিধ অনুষ্ঠানও হতো। উল্লেখ্য, অনুমোদনবিহীন শহীদ মিনার স্থাপনার জন্য কর্তৃপক্ষ রুষ্ট হয়ে কেন শৃঙ্খলাবিরোধী কর্ম সম্পাদনের জন্য শাস্তি-বিধান করা হবে না, সে মর্মে শো-কজ নোটিশ দিয়েছিলেন ছাত্র সংসদের পাঁচ জনকে। আয়োজিত বিচিত্রানুষ্ঠানে স্থির হয় আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’ কবিতাটি সুর দিয়ে গীত হবে। সুর দিলেন গায়ক আবদুল লতিফ এবং গাইলেনও তিনি।

শহীদ রফিকউদ্দিনের লাশ দেখে (১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি) আবদুল গাফফার চৌধুরী বিচলিত হয়ে কবিতাটি লিখেছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের কবিতা সংকলনে কবিতাটি প্রকাশ হয়েছিল। কবিতাটি শুধু যে শহীদদের স্মরণে শোকগাথা, তা-ই নয়; সর্বাধিক অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদাত্ত আহ্বান কবিতাটিতে বিধৃত। প্রথমে আবদুল লতিফ যে সুর দিয়েছিলেন, তা বর্তমান সুর থেকে ভিন্ন ছিল। অনুষ্ঠানে নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ-কপাট ভেঙে ফেল...’ এর পরে খুব বলিষ্ঠ এবং উদাত্ত কণ্ঠে আবদুল লতিফ গানটি গাইলেন। কয়েক মাস পরেই সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ গানটিতে বর্তমানের হৃদয়স্পর্শী ছন্দোময় সুর আরোপ করেন এবং এটাই আজ এই গানের স্বীকৃত সুর। কালজয়ী এই সুরেই গানটি সকল প্রভাতফেরি এবং অনুষ্ঠানে গীত হতে থাকল। আবদুল লতিফ  ছাড়াও ওই গানটিতে কণ্ঠসুর সংযোজন করেছিলেন ছাত্র ও শিল্পী আতিকুল ইসলাম। পরে স্পেশাল-ব্রাঞ্চ পুলিশ রিপোর্ট করেছিল যে, এই বিচিত্রানুষ্ঠান থেকে জেল-ভেঙে বন্দি-মুক্তি এবং রাষ্ট্রবিরোধী সাম্যবাদী বিপ্লবের আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং এর উদ্যোক্তারাই করেছিলেন কলেজে অনুমোদনহীন শৃঙ্খলাবিরোধী শহীদ মিনার স্থাপন। কলেজের গভর্নিং বডি জরুরি সভা আহ্বান করে সিদ্ধান্ত নিল শাস্তি প্রদানের। ফলে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন পাঁচজন : ভিপি মশির হোসেন (পরবর্তী জীবনে সাংবাদিক), জিএস ইনাম আহমদ চৌধুরী, ছাত্রনেতা ইকবাল আনসারী খান, গায়ক আতিকুল ইসলাম এবং গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী। এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে কলেজে ছাত্র-ধর্মঘট শুরু হয়। একসময় তাঁরা তৎকালীন বিরোধী নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রমনা রেস্ট হাউসে গিয়ে দেখা করেন তাঁর উপদেশ বা নির্দেশের সন্ধানে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় সর্বপ্রথম (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু বলে অভিহিত হননি) শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কীর্তিমান শিষ্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-আদায় সংগ্রামের সফল নেতা। তিনি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের এই আন্দোলনকে কলেজে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রীকে শামিল করতে বললেন। অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা তা-ই করলেন। আর মাসখানেকের আন্দোলনের মুখে বহিষ্কারাদেশটি প্রত্যাহার হলো।

বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেকটা সময় জুড়ে ছিল তাঁর অধিষ্ঠান। তাঁর এই সর্বময় অধিষ্ঠানের সবচেয়ে আলকোজ্জ্বল অধ্যায় হলো ৫২-র ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। স্বাধীনতাপূর্বকালে এই গানটি ছিল বাঙালি-জীবনে শক্তি ও প্রেরণার উৎস এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতীয় সংগীতের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বমহলে তুলনারহিত নন্দিত গান। একটিমাত্র গান একজন মানুষকে এতটা অমর করে তুলতে পারে তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কি না আমাদের জানা নেই। সুতরাং বলা যায় যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, যত দিন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন এই গানটি থাকবে এবং এই গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী থাকবেন। সুতরাং তাঁর লোকান্তর তাঁকে বিন্দুমাত্র বিস্মৃত করার ঘটনা নয়, অধিকন্তু ইহকালে তিনি যে বৈভবে বেঁচে ছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি অনুরূপ বৈভব ও মর্যাদা নিয়ে অমর হয়ে থাকবেন।

বাঙালির জীবনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল নাম আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাওরে, বাওরে, পাহাড়ে, চরে- সর্বত্র একজন শিশু স্কুলের গণ্ডির ভেতরে যখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল হাতে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারের দিকে অগ্রসর হয়, তখন তার মুখে উচ্চারণ হতে থাকে সেই অমোঘ বাণী : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’; তখন সে তার কণ্ঠে ধারণ করে ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি জাতির উত্থানকে, মুক্তিযুদ্ধকে, স্বাধীনতাকে। সেই উচ্চারণের বাণীবন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান আবদুল গাফফার চৌধুরী। প্রতিটি বাঙালি-জীবনে শৈশব থেকে আমৃত্যু এই অমোঘ বাণী সগৌরবে ধারণ করতে হয় এবং তার পরিধি আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত। বিষয়টি এমন নয় যে, অপরাপর গানের মতো এই গানটিও তার চেতনার ভেতরগত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকন্তু মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে এই গানটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতি ও অর্থনৈতিক এমন কোনো বঞ্চনা নেই যে, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খড়গ উঁচু না করে। এ হলো প্রমূর্ত এক প্রতিবাদ-বাণী, অমোঘ অস্ত্র। যারা এর ধারক তারা কি এর স্রষ্টাকে ভুলে যেতে পারে? পারে না। এক জীবনে অসংখ্য সম্মান তিনি পেয়েছেন, কত মানুষের ভালোবাসা তিনি লাভ করেছেন, কত প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার আর সম্মাননা তিনি অর্জন করেছেন, কত বই তিনি রচনা করছেন। তারও পরিমাণ কম নয়। বাংলা সাহিত্যের ভুবনে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। আবদুল গাফফার চৌধুরীর এই সকল কর্ম, লেখা, সকল কীর্তি মুছে গেলেও এই একটি অমর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সৈয়দ শামসুল হককে এক আলাপনে আবদুল গাফফার চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন, ‘তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি মৃত্যুর পর কী হিসেবে বেঁচে থাকতে চাও?’ উত্তরে সৈয়দ শামসুল হক জানিয়েছিলেন, ‘মৃত্যুর পরে একজন বাঙালি হিসেবে বাঙালির মনে বেঁচে থাকতে চাই।’ আর আবদুল গাফফার চৌধুরীর জবাব ছিল ‘আর আমি একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। আমি এ কথা বলব না যে, আমি একজন সৎ মানুষ ছিলাম কিংবা অসৎ মানুষ ছিলাম। আমি আঁদ্রে জিদের সেই কথাটা বিশ্বাস করি, আমি যা, তার জন্য আমি নিন্দিত হতে রাজি আছি; আমি যা নই, তার জন্য আমি প্রশংসিত হতে রাজি নই।’ দেহগত মৃত্যুর ভেতর দিয়ে বাঙালির হৃদয়ে তাঁর এই পরম সৌভাগ্যের বেঁচে থাকা। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি আমাদের পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা