বিপ্লবী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার উদীচী

Looks like you've blocked notifications!

বিপ্লবী এক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে উদীচী। নব সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রত্যয়ে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে উদীচীর জন্ম। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যখন ফুঁসে উঠেছিল বাংলার আপামর মানুষ, একটি কালজয়ী গণঅভ্যুত্থান যখন উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে, ঠিক সে রকম একটা সংগ্রামমুখর সময়ে ঢাকা তথা গোটা বঙ্গদেশের গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ, বিশিষ্ট সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। উদীচীর শিল্পীকর্মী ভাই ও বোনেরা উদীচী জন্মের পর থেকেই ভূখণ্ডের মানুষের মুক্তি তথা সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা, কখনো রাইফেল হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, আবার কখনো ক্লান্ত-শ্রান্ত, বিধ্বস্ত মুক্তিসংগ্রামীর প্রাণে সাহস সঞ্চারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উদীচীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। উদীচী এটা করেছে গণসংগীত, গণনাটক, আবৃত্তি, নৃত্যকে অবলম্বন করে। মানুষকে পথ চলতে প্রেরণা যুগিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশীয় দখলদার-মজুতদার-মুনাফাখোর, কালোবাজারীরা যখন বিনষ্ট করতে চেয়েছে দেশের সম্মান, আপন স্বার্থে বিকিয়ে দিতে চেয়েছে দেশের সম্পদ, তখনো তার বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন উদীচীর শিল্পীরা গেয়ে উঠেছে গণসংগীত। উজ্জীবিত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে স্বার্থান্বেষী মহল। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিল্পীরা যাতে বঞ্চিত-নিপীড়িত-শোষিত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে এসেছে উদীচী।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি ঝড়-ঝঞ্ঝা-দৈব-দুর্বিপাকে, আন্দোলন-সংগ্রামে সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে উদীচী। দুর্গতদের সাহার্যার্থে কখনো একা আবার কখনো কখনো অপরাপর সংগঠনসমূহকে সাথে নিয়ে উদীচী সব হারানো মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং তাদের জয়-পরাজয়ের সাথি হয় উদীচী।

উদীচী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরোধিতা করার পাশাপাশি দেশীয় দুর্নীতিবাজ ও সমাজবিরোধীদের প্রতিহত করার সংগ্রামে নিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। আর এসবই করছে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা ও কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অন্তরে চৈতন্যে ঝড় তুলতে যে কালজয়ী গণসংগীতগুলো উদীচী গাইত, তার মধ্যে অন্যতম ‘ওরে ওরে বঞ্চিত সব হারা দল’, মারো জোয়ান হেইয়ো মারো কসে টান’, ‘বল জয় জয় জয় বর সর্বহারার জয়’, ‘ভাইরে বুঝবি কি আর মলে’, ‘আগুন নেভাইবো কে রে, এ আগুন নেভে নেভে নেভে না’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল’, ‘গেরিলা আমরা গেরিলা’, ঝঞ্ঝা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক, ভয় যারা পায় তাদের ছায়া দূর মিলাক’, ‘উঠলোরে ঝড় দিন বদলের পালা এলো’ ইত্যাদি। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর উদীচী প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে নাটকগুলো করেছে সেগুলো হলো ‘আলো আসছে’, ‘শপথ নিলাম’, ‘পোস্টার’, ‘জীবন তরঙ্গ’, ‘প্রিয়তমাসু’, ‘সামনে লড়াই’।

মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে জনগণের হাতে হাত রেখে নান্দনিক উপস্থাপনার পাশাপাশি রাস্তার লড়াইয়েও এক মেলবন্ধন তৈরি করে উদীচীর শিল্পীসংগ্রামীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ বের হয় উদীচীর ট্রাকস্কোয়াড। যার ব্যাকগ্রাউন্ডে আঁকা থাকে সূর্যের মাঝখানে শৃঙ্খলিত হাত। সূর্যটি যেন কাঁটাতারের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসছে। পাশে শহীদ মিনার। তাতে স্লোগান লেখা হয়েছে,‘একুশের শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করুন’। ৫ মার্চ বাংলার জনগণের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমর্থনে উদীচী এক মিছিল বের করে। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সেগুনবাগিচা এলাকায় এসে পথসভা করে। সেখানে উদীচীর সভাপতি সত্যেন সেন দেশের বর্তমান দুর্যোগ মুহূর্তে সকল প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের গণআন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। ৬ মার্চ সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররমের কাছ থেকে আবার মিছিল বের হয় উদীচী সেই সময়কার সহসভাপতি রণেশ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে। ১০ মার্চ উদীচীর সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতির মাধ্যমে বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে আগাইয়া নেওয়ার প্রত্যয়ে সবাইকে সৈনিকসুলভ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা লইয়া শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।

এর পর আসে চূড়ান্ত সংগ্রামের পর্ব। রাইফেল হাতে সরাসরি যুদ্ধে নামেন উদীচীর শিল্পীকর্মীরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নয় মাস উদীচীর প্রায় সকল কর্মী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন অথবা কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ গৌরবজনক স্বাধীনতা লাভ করার পর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ে সংগ্রাম। মুক্ত স্বদেশে উদীচীর শিল্পী সৈনিকেরাও অস্ত্র জমা দিয়ে আবার হাতে তুলে নেয় ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, তবলা, নাটকের পাণ্ডুলিপি। শুরু হয় দেশ গড়ার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে উদীচীর কর্মীরা রাস্তায় নেমেছেন তার সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে।

স্বাধীন দেশে প্রতি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে মিশে আছে ‘উদীচী’ নামটি। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মাধ্যমে যখন স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জনসমূহ ধ্বংস করতে চেয়েছে তখনো উদীচীর সংগীত, নাটক, আবৃত্তি কথা বলেছে। ১৯৭৪ সালে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ও সামাজবিরোধীরা কালোবাজারি আর মজুতদারিতে মেতে ওঠে, যখন রাতারাতি বড়লোক হওয়ার অসৎ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, চারদিকে যখন তীব্র সংকট ঘনীভূত, তখনো উদীচীর নাট্যকর্মীরা রাস্তায় নামে ‘সাচ্চা মানুষ চাই’ নাটক নিয়ে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সমগ্র জাতি যখন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, সারা দেশে বিরাজ করতে থাকে স্থবিরতা, রাজনৈতিক সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ অতিবাহিত করতে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন। সারা দেশ তখন স্তব্ধ, মূক। কেউ কোনো কথা বলে না। উদীচীর শিল্পীরা তখন সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে, ‘এদেশ বিপন্ন বিপন্ন আজ’, ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’, ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’ ইত্যাদি। মাহমুদ সেলিমের নেতৃত্বে রচিত হয় গীতি-আলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’। সেই গীতি-আলেখ্যের ভেতর দিয়ে উদীচী বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর অবদান, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ তুলে ধরে।

১৯৭৮ সালে দেশে হঠাৎ মূর্তি ভাঙা শুরু হলে তার প্রতিবাদে কাজী আকরাম হোসেনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে উদীচী পরিবেশন করে নৃত্যনাট্য ‘প্রতিরোধ’। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত উদীচী ধারাবাহিকভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গান ও পথনাটক রচনা করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছে। গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর প্যারোডি ‘নতুন জংলি ড্রেস’, ‘কথা কইলে হেয় চেইত্যা যায়’, ‘কুহুকুহু ডাক শুনিয়া’, ‘বড় গঙ্গে শাসনতন্ত্র’, ‘আমি মীরজাফর আলী, এসেছি আঁধার রাতে’, ‘আমার ভাগার সময় হলো দাও বিদায়’ এবং আরও অনেক গান ও পথনাটক। এ সময় উদীচী যে নাটকগুলো পরিবেশন করে, তার মধ্যে অন্যতম ‘হইতে সাবধান’, ‘নরক গুলজার’, ‘আমার মাটি আমার ধান’, ‘মিছিল’, ‘দিন বদলের পালা’, ‘ধলা গেরামের নাম’, ‘রাজা রাজা খেলা’। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার এ সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তৈরি করে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সেসব উপেক্ষা করে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসন প্রহসনের চিত্র তুলে ধরে সেন্টু রায়ের রচনায় উদীচী মঞ্চস্থ  করে ‘রাজা রাজা খেলা’ নাটক।

’৮০-র দশকে এরশাদের দুঃসাশনের বিরুদ্ধে বৃন্দ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। পাশাপাশি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে উদীচী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখে। ১৯৮৮ সালে রেজাউল করিম সিদ্দিক রানার গ্রন্থনায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কবিতা ও গানের স্ক্রিপ্ট পরিবেশিত হয়। যার মধ্যে খুলনার এস এম জাকারিয়ার ‘কি আজগুবি কারবার, একাত্তরে ছিল যারা খুনি রাজাকার, আজকে তারা ধর্মের নামে সাজেন পরহেজগার’, বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শুন হে মানুষ ভাই’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ প্রভৃতি কবিতা ও গান স্থান পায়।

আদমজীসহ দেশের অন্যান্য পাটকলসমূহ বন্ধ ঘোষণা করলে, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ও সমুদ্র বক্ষে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব আসলে, সুন্দরবনসহ দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংসের যেকোনো ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সারা দেশে উদীচীর সংস্কৃতিকর্মীরা প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে।

সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে উদীচীর সংগ্রাম নিয়ত। তাই তো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যখনই আমাদের ওপর চেপে বসেছে, তখনই উদীচীর শিল্পীকর্মীরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে।

আমরা এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও উদীচীর ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছি। বাঙালি জাতির জন্য এটা অত্যন্ত গৌরবের, ঐতিহ্যের। তবে মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশটাকে আজ যে চেহারায় দেখার কথা ছিল, সে চেহারায় দেখতে পারছি না। উদীচী, ছায়ানটসহ দেশে অগণিত শিল্পীকর্মী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সংস্কৃতির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে। উদীচীর এ সংগ্রাম থামবে না কখনো। অব্যাহত থাকবে তাঁদের এ দ্রোহী পথচলা।

লেখক : সহ-সাধারণ সম্পাদক, উদীচী