বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল আমাদের অনুপ্রেরণা

Looks like you've blocked notifications!

শেখ জামাল (২৮ এপ্রিল ১৯৫৪-১৫ আগস্ট ১৯৭৫) শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গৃহবন্দি ছিলেন। তিনি ’৭১-এর আগস্টের শুরুর দিকে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সক্ষম হন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের একজন কমিশন্ড অফিসার ছিলেন।

জন্ম ও শৈশব

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। অন্য ভাই-বোনের মতো তাঁকেও পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছে। কারণ, পিতা মুজিবকে বেশির ভাগ সময় জেলেই কাটাতে হয়েছে, আর জেলের বাইরে এলেই তিনি পূর্ববাংলার মানুষের ভাগ্য বদলে দেবার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতেন। শেখ মুজিব জামাল ভূমিষ্ট হওয়ার ১২ দিন পর অর্থাৎ ১০ মে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি পরিবারকে একটু সময় দেওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় ছোট্ট শিশু শেখ জামালসহ তাঁর পরিবারকে টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় মিন্টু রোডের সরকারি বাসভবনে স্থানান্তর করেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে, পূর্ব বাংলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং শেখ মুজিবসহ সকল মন্ত্রিসভা সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। সেই প্রেক্ষাপটে সরকার মিন্টু রোডের সরকারি বাড়ি ১৪ দিনের মধ্যে ছাড়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়। ফলে, কয়েক দিনের মধ্যেই ওই বাসা ছেড়ে বঙ্গমাতা বেগম মুজিব ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে নাজিরাবাজারে একটি ভাড়া বাড়িতে (সুলতানদের বাড়ি) ওঠেন। পিতার অত্যন্ত আদরের জামাল মায়ের কোলে চেপে অপলক দৃষ্টিতে বন্দি বাবাকে দেখত জেলগেটে। সে বার শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছিলেন ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ। নিয়মিত কারাবরণই ছিল যেন তাঁর ভাগ্যরেখায়। পিতা মুজিব জেলে থাকলেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকতেন। জেলের নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিন পরপর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেতেন। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ও স্বাস্থ্যের খবর রাখতেন। সন্তানদের কেউ জেলগেটে না এলে উদ্বিগ্ন থাকতেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবরে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ওঠেন। এর পূর্বে তাঁরা নাজিরাবাজার, আরমানীটোলা, আবার নাজিরাবাজার, ১৫ নম্বর আব্দুল গণি রোড, সেগুনবাগিচার ১১৭ নম্বর বাড়ি, ১১৫-সিদ্ধেশ্বরী, পুনরায় সেগুনবাগিচার ৭৬ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সেগুনবাগিচার বাসা থেকে শেখ জামাল ভাইবোনসহ নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণের জন্য রমনা পার্কে যেতেন। প্রাতঃভ্রমণ শেষে বাসায় ফিরে পরিবারের সকলেই পত্রিকা নিয়ে বসতেন। বরাবরের মতোই বঙ্গবন্ধুর নজর থাকত রাজনৈতিক খবরে; বঙ্গমাতার আগ্রহ ছিল সামজিক বিষয়ে, শেখ কামাল খেলাধুলার খবরে, আর জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পড়তেন সাহিত্য পাতা ও চলচিত্র সংবাদ। শৈশব থেকেই শেখ জামাল ছিলেন অত্যন্ত হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত। কিশোর বয়সে তাঁর অলরাউন্ডার বড় ভাই ক্যাপ্টেন শেখ কামালের মতো তিনিও হয়ে উঠেছিলেন ক্রীড়ানুরাগী। তিনি ক্রিকেট, হকি ও ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি আবাহনীসহ কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশের খেলাধুলার খবর রাখতেন। লেখাপড়া ও খেলাধুলার পাশাপাশি তিনি ছায়ানটে গিটার শিখতেন। শেখ জামাল অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে পছন্দ করতেন, কখনও বা সিনেমা-নাটক দেখতে যেতেন। তিনি মুরুব্বিদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। শেখ জামাল ছিলেন অত্যন্ত পড়ুয়া প্রকৃতির; সারাক্ষণ তিনি বই নিয়ে পড়ে থাকতেন। তিনি কিছুদিন বিমান বাহিনীর শাহীন স্কুলে পড়তেন। এরপর ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে ছাত্রাবাসে থাকতেন। তিনি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বাংলাদেশ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

’৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট খেলা দেখতে বন্ধুরাসহ শেখ জামালও ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চের গণ-পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে সকলের সঙ্গে শেখ জামালও প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়েও শেখ জামাল রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের উত্তাল ঢাকায় বন্ধুরা মিলে মিছিল দিতে দিতে তাঁরা ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফিরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা লিখে যাওয়ার পরপরই পাক সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হন। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য বেরিয়ে পড়েন। ৩২ নম্বরের বড়িতে থেকে যান বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসা, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল। ২৬ মার্চ পুনরায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের বাসা আক্রমণ করে। এর পূর্বেই পাশের বাসার ডা. সামাদ সাহেব তাঁর বড় ছেলেকে পাঠিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেলকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান।

২৭ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফুফাত ভাই মোমিনুল হক খোকা এই তিন জনকে নিয়ে সাত মসজিদ রোডের উপর ধানমণ্ডি (পুরাতন) ১৫ নম্বর রোডের (নতুন ৮/এ-১৭৭) ভাড়া বাসার সন্নিকটে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন কিউ বি এম রহমান বাশারের বাসায় সাময়িক আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু পরিবার ১ এপ্রিল হতে খিলগাঁও গোলচক্করে ঢোকার প্রধান পথের পাশের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেন। সেখানে পরিচয় জানাজানি হলে এক সপ্তাহের মধ্যেই বেগম বদরুন্নেসার মগবাজার চৌরাস্তার নিকট প্রধান সড়কের উপর আরেকটি বাড়িতে স্থানান্তর করেন। এই বাসায় থাকার সময় পত্রিকার ছবি দেখে পরিবারের সবাই জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করা হয়েছে। ওই বাসাতেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা হানা দেয়; সেখান থেকে কয়েক দিন পরে পাশেই আরেকটি বাড়ির দোতালায় ভাড়া নিয়ে বাসা পরিবর্তন করেন। সেই বাসা থেকে ১২ মে বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর হোসেন শেখ জামালসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করে ধানমণ্ডির ৯/এ (পুরাতন ১৮) সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে বন্দি করে ১৫/২০ জন পাকিস্তানি সৈনিকের পাহারায় রাখে। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে মাত্র দেড় মাস সময়ে ১৯ বার অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছিল। শেখ জামাল পরিবারের অন্যান্য বন্দি সদস্যসহ নিয়মিত ‘জয় বাংলা’ বেতার শুনতেন। সে সময় পাকিস্তানিরা ‘স্বাধীন বাংলা’ বেতারকে ‘জয় বাংলা’ বেতার বলে তাচ্ছিল্য করত। এ জন্য তাঁদের পুরো পরিবারকে বারবার খানসেনাদের ধমক খেতে হতো। এমনও বলা হয়েছিল, ‘জয় বাংলা’ বেতার শুনলে জামালকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ‘পা-বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে পিঠের চামড়া ওঠানো হবে।’

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করাই শেখ জামালের একমাত্র লক্ষ্য ও প্রত্যয় ছিল। এ জন্য তিনি বেশ কৌশলী হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে গেরিলা কায়দায় একজন পাকসেনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, তাঁদের সঙ্গে খাবার খান, তাঁদের অস্ত্র পরিষ্কার করে দেন, এবং একই  সঙ্গে বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি পাহারারত পাকসেনাদের থেকে বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার অনুমতি নেন। এরই মধ্যে ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে উত্তর প্রদেশের কালশীতে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেসে (মুজিব বাহিনী) যোগ দিয়ে ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের ‘বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ’ গ্রহণ করেন। এরপর শেখ জামালের ঠিকানা হয় রণাঙ্গনের ৯ নম্বর সেক্টর। রণাঙ্গনে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল হয়ে উঠেছিলেন সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। লক্ষ্য ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতা এবং পিতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। ’৭১-এর ২ ডিসেম্বর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভিতরে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে সেমি-অটোম্যাটিক ভারী মেশিনগানে গুলি ভরছিলেন। বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল এক অদম্য সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার লক্ষ্যভেদী নিশানা।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবার। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর তাঁরা ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মুক্তি পান এবং পাহারারত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৯ ডিসেম্বর দুই ভাই ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল যুদ্ধফ্রন্ট থেকে সামরিক পোশাকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের বাসায় ফিরে আসেন।

স্যান্ডহার্স্টের প্রশিক্ষণ ও সেনাবাহিনীতে যোগদান

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন। শেখ জামালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রবল আগ্রহ দেখে টিটো তাঁকে যুগোস্লাভিয়া মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ওই বছরের বসন্তে ঢাকা কলেজের ছাত্র ও একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং ভাষাগত অসুবিধার কারণে সেই প্রশিক্ষণের সঙ্গে তাল মেলানো তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্শাল টিটো শেখ জামালকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন, যেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। সে সময় প্রশিক্ষণ একাডেমির কমান্ড্যান্ট ছিলেন মেজর জেনারেল রবার্ট ফোর্ড।

১৯৭৪ সালের শরতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে শেখ জামাল লন্ডনে গিয়ে পৌঁছান। তবে স্যান্ডহার্স্টের পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁকে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ এবং বেকনসফিল্ড থেকে প্রয়োজনীয় পূর্ব-প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। লন্ডনে যাওয়ার পর তিনি ‘সেলফ্রিজ’ নামের একটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নেন। সেই উপার্জন দিয়ে তিনি নিজের হাত খরচ চালান এবং স্যান্ডহার্স্টে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি স্যান্ডহার্স্টের স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি কোর্স-৮ শুরু হয় এবং একই বছর ২৭ জুন অংশগ্রহণকারীদের পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কমিশন লাভ করেন তিন জন গর্বিত তরুণ অফিসার ক্যাডেট শেখ জামাল, আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ এবং মাসুদুল হাসান। শেখ জামাল ১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট থেকে স্যান্ডহার্স্টেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাঁর দুই প্রিয় বন্ধু বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন জেনে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে, দেশে কিছুদিন থেকে আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর।

স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে। এখানে তাঁর চাকরিকাল ছিল প্রায় দেড় মাস। এরই মধ্যে তিনি পরিবারের মতামতে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই ফুফাতো বোন পারভীন রোজীকে বিয়ে করেন। তিনি সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ে নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে অফিস করতেন। স্বল্প সময়েই তিনি অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে চমৎকার পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন।

হৃদয়বিদারক মৃত্যু

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে শেখ জামাল ক্যান্টনমেন্টে আসেন। নায়েব সুবেদার বার্কি বলেন, ‘স্যার, অনেক রাত হয়েছে; আজ রাতে ইউনিটেই থেকে যান।’ কিন্তু রাতে আর সেনানিবাসে থাকা হয় না শেখ জামালের। তিনি ফিরে আসেন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে। ততক্ষণে কলঙ্কিত ‘ঘাতক দল’ শতাব্দীর এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলায় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসার শোবার ঘরেই শেখ জামাল, সুলতানা খুকি ও রোজী জামালকে গুলি করে হত্যা করেছিল ঘাতকেরা। বঙ্গমাতা হয়তো সে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সবাইকে রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, তাঁকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত ঘাতকের দল। সবার শেষে পরিবারের সকলের লাশ ডিঙিয়ে নিয়ে সেই ঘরেই হত্যা করেছিল দশ বছরের নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন শেখ জামাল হত্যার শিকার হন, তখন তিনি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট। সেনাবাহিনীরই একটি অংশের হাতে তিনি নিহত হলেন যারা কিনা মনেপ্রাণে পাকিস্তানপন্থি এবং স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে সেনাবাহিনীর যে সদস্যরা হত্যা করেছিল, তাদের সেনা আইনে বিচার না করে সে সময়ের অবৈধ সরকার খুনিদের পুরস্কৃত করে। সেই ঘৃন্যতম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার করা যাবে না বলে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে। খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দেয়, দুজন খুনিকে জনগণের ভোট চুরি করে জাতীয় সংসদে সদস্যপদ দেয়। এমনকি খুনিদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়। সংবিধান, গণতন্ত্র এমনকি সেনা আইন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চালু করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। যে স্বাধীনতা জাতির পিতার সারা জীবনের আত্মত্যাগ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং সর্বোপরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল।

শেখ জামালসহ পরিবারের সবাই শায়িত আছেন বনানী কবরস্থানে। আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব