যেভাবে ধর্মীয় সংঘাতে ঘি ঢালছে ফেসবুক

Looks like you've blocked notifications!

মুবাশ্বার হাসান, জেফরি ম্যাকডোনাল্ড এবং হুই হুই অই’র এ লেখাটি ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে সাম্প্রতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত হিসেবে প্রকাশ হয়েছে। লেখকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কন্টেন্ট মডারেশন নীতিমালা বাংলাদেশে ব্যর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে কীভাবে এ নীতিমালা ঠিকঠাক করা যায়, তা তুলে ধরেছেন তাঁরা। লেখাটি অনুবাদ করেছেন ইয়াসির আরাফাত।

গত অক্টোবরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বেশ কিছু বাড়ি ও মন্দিরে মুসলমানদের কয়েকশ হামলার ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ। কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওই সংঘাতে ছয় জন নিহত এবং অনেকে আহত হন। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া দুটি পোস্টের পরই এসব হামলার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমটি হচ্ছে—একটি হিন্দু মন্দিরে (পূজামণ্ডপে) পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে একটি ফেসবুক লাইভ। আর দ্বিতীয়টি—একজন হিন্দু ব্যক্তির ইসলামের সমালোচনা করার অভিযোগ।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্ল্যাটফর্মের সম্ভাব্য বিপজ্জনক ব্যবহার নিয়ে বেশ সজাগ রয়েছে ফেসবুক। এর ব্যবহারের শর্তাবলী অনুযায়ী, যেকোনো সময় এ প্ল্যাটফর্মে থাকা হুমকিমূলক বক্তব্য এবং ক্ষতিকর কন্টেন্ট মুছে দেওয়ার অধিকার রাখে ফেসবুক। এসব ক্ষেত্রে ফেসবুকের যে নীতিমালা বা নির্দেশনা, তা তারা নিয়মিত হালনাগাদ করে আসছে। গত কয়েক বছরে হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ তাদের সব পণ্যে ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিতে ফেসবুকের করপোরেট মালিকানা প্রতিষ্ঠান (বর্তমানে ‘মেটা’) শত শত কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে।

কিন্তু, এতসব প্রচেষ্টা ঘৃণা বা বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যে ভর করে সৃষ্টি হওয়া সংঘাত থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে হামলার ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে ফেসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউজেন বিদ্বেষ ও সামাজিক বিভাজন বিষয়ে কোম্পানিটির সামঞ্জস্যহীন পদক্ষেপের কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আক্ষরিক অর্থেই জাতিগত সংঘাত ছড়াতে ভূমিকা রাখছে ফেসবুক।’ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হেনস্তার বিষয়ে নীতিমালায় সংশোধন এনেছে কোম্পানিটি। কিন্তু, তাতে এ সংকটের সমাধান হয়েছে সামান্যই।

ফেসবুকের বিক্ষিপ্তভাবে একটু একটু করে পদক্ষেপ নেওয়ার কন্টেন্ট মডারেশন নীতি বাংলাদেশে ও বিশ্বজুড়ে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ভয়াবহ পরিণতিও দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে সাধারণ কোনো ব্যক্তির করা ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠদের সংঘবদ্ধ হতে দেখা যায়। ফেসবুক আমলের আগে এসব ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক প্রচারণার ফলে রাজপথে আন্দোলন-বিক্ষোভ হতো এবং মুখে মুখে ছড়াতো, কালেভদ্রে তা সংঘাতেও গড়াতো। কবি শামসুর রাহমানের বির্তকিত চিন্তাভাবনার কারণে ১৯৯৯ সালে তাঁর ওপর নৃশংস হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।

ফেসবুক এ ধরনের ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোর মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতেরা আগ্রহ নিয়ে এগুলো ছড়িয়েছে। গত এক দশকে এসব ফেসবুক পোস্ট বাংলাদেশজুড়ে সংখ্যালঘুবিরোধী সংঘাত বাড়িয়ে তুলেছে। ফেসবুক থেকে উৎসাহিত হয়ে ঘটানো প্রথম বড় সংঘাতের ঘটনাটি ২০১২ সালের। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ট্যাগ করা পোড়ানো পবিত্র কোরআনের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক হাজার মুসলমান একটি বৌদ্ধপল্লিতে হামলা চালায়। ওই হামলার ঘটনার পর অন্তত এক হাজার বৌদ্ধ পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়েছে।

এরপর থেকে হামলা বছরের পর বছর বেড়েই চলেছে। ফেসবুকে হিন্দু এক ব্যক্তির মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অবমাননার ভুল অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে মুসলিম দাঙ্গাকারীরা বেশকিছু হিন্দু গ্রামে হামলা করেছিল। ২০১৪ সালের ঘটনায় অন্তত ১৫টি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয়। ২০১৭ সালে ২০ হাজারের মতো মানুষ একসঙ্গে গিয়ে একটি হিন্দু গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০১৯ সালে হিন্দু গোষ্ঠীর ওপর এক হামলায় চার জনের প্রাণহানি ঘটে এবং ৫০ জন আহত হয়। ফেসবুকে কথোপকথনে মুহাম্মাদ (সা.)-এর অবমাননা করেছেন—এমন অভিযোগে ২০২১ সালের শুরুর দিকে এক হিন্দু লোকের গাড়ি ও বাড়িঘরে ভাঙচুর চালানো হয়।

গত এক দশকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে তাঁদের অনলাইন পোস্ট দেখে হত্যা করেছে ইসলামপন্থিরা। এসব ব্লগারের কেউ হিন্দু, কেউ নাস্তিক, আবার কেউ মুসলমান। এমন হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা দেখে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। আহমাদিয়ার মতো সংখ্যালঘু মুসলিম গোষ্ঠীগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। ধর্মীয় অবমাননার ভয় ডিজিটাল হয়েছে, আর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রসদ জোগানোর সক্ষমতাও বাড়িয়েছে ফেসবুক।

ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রতিরোধে সাধারণত অ্যালগরিদম, ব্যবহারকারীর রিপোর্ট (অভিযোগ) এবং নিজেদের কন্টেন্ট মডারেটরদের ওপর নির্ভর করাসহ বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করে ফেসবুক। কোম্পানির অ্যালগরিদম সেভাবেই তৈরি করা, যাতে করে ক্ষতিকর কন্টেন্ট চিহ্নিত এবং মুছে দেওয়া সম্ভব হয়। একইভাবে ব্যবহারকারীদের রিপোর্ট করা পোস্টগুলো ফেসবুকের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় রিভিউ হয়। তবে, এ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে সেগুলো মানব কন্টেন্ট মডারেটরদের কাছে পাঠানো হয়। তাঁদের অনেকে আবার ভাষাগত জটিলতার সম্মুখীন হন এবং বিপুল কন্টেন্ট হওয়ায় ব্যান্ডউইথ ঘাটতির ফলে তা দ্রুত দেখে ছাড়তে পারেন না।

প্ল্যাটফর্মে ক্ষতিকর কন্টেন্ট ছড়ানোর মাত্রা বেড়েছে, ফেসবুকও একই সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিষয়ে এবং এসব কমানোর উপায় সম্পর্কিত দক্ষতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে হ্যাকিং, স্প্যাম ও নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল তথ্য ছড়ানোর কাজে জড়িত থাকার দায়ে বহু অ্যাকাউন্ট মুছে দিয়েছে ফেসবুক। সম্প্রতি, ফেসবুক বাংলাদেশে প্রথম পাবলিক পলিসি ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছে এবং বাংলা-ভাষাভাষী কর্মীসংখ্যা বাড়িয়েছে। 

এ মডারেশন কৌশল যে অপ্রতুল, তা অবশ্য প্রমাণিত। গত বছর প্রকাশিত ফেসবুক পেপারস থেকে জানা যায়, ফেসবুকের অ্যালগরিদম অনলাইনের ঘৃণামূলক বক্তব্যের পাঁচ শতাংশেরও কম ধরতে পারে। সর্বশেষ সংঘাতের ঘটনার ভিডিওটি ছয় দিন পর্যন্ত ফেসবুকে ছিল এবং প্ল্যাটফর্ম কর্তৃপক্ষ তা নামিয়ে নেওয়ার আগে ৫৬ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছিল। প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ থাকলেও কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরে যৎসামান্য ব্যবস্থাগ্রহণসহ এ খাতে প্রয়োজনের তুলনায় কম ব্যয় করে আসছে। সীমিত মজুরির কারণে মডারেটরদেরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয়।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে—ইংরেজি-ভাষাভাষী পশ্চিমা দেশগুলোতে ফেসবুকের মডারেশন কার্যক্রম জোরালো। কিন্তু, অন্যান্য অঞ্চলকে অবজ্ঞা করা হয়। অথচ এসব জায়গায় ঘৃণা-বিদ্বেষ যে আরও মারাত্মক, তা প্রমাণ করা যাবে। এসব দেশে সংঘাত কমানোর কাজ জোরদার করতে প্ল্যাটফর্মটির একান্ত নিজস্ব সক্ষমতা পর্যাপ্ত করতে হবে। এর মধ্যে কর্মী নিয়োগ বাড়ানো, স্থানীয়দের ব্যবহার করা, আরও বেশি ভাষায় ঘৃণা-বিদ্বেষ বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং দেশভিত্তিক পরিস্থিতি, সংস্কৃতি ও চলমান ধারা বিবেচনায় নিতে প্রোডাক্ট ডিজাইনারদের জ্ঞান বাড়ানোর ব্যবস্থা করার বিষয়গুলো রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ‘ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট’ যেমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে সহায়ক হয়েছে, বাংলাদেশ  সরকারও এমন নিয়ন্ত্রক বিধি ব্যবহার করতে পারে।

...

মুবাশ্বার হাসান ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনির হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অ্যাডজাঙ্কট ফেলো। ‘ইসলাম অ্যান্ড পলিটিক্‌স ইন বাংলাদেশ : দ্য ফলোয়ার্স অব উম্মাহ’ বইয়ের লেখক তিনি।

জেফরি ম্যাকডোনাল্ড ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর।

হুই হুই অই ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের প্রযুক্তি এবং গণতন্ত্র বিভাগে জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং ‘কমব্যাটিং ইনফরমেশন ম্যানিপুলেশন : এ প্লেবুক ফর ইলেকশন্স অ্যান্ড বিয়ন্ড’ বইয়ের লেখক।