যে নাম নাড়া দেয় হৃদয়ে

Looks like you've blocked notifications!

শেখ রাসেল একটি আবেগের নাম। সবার পরিচিত একটি নাম। সবার প্রিয় একটি নাম। সব বয়সি মানুষের প্রিয় নাম। শুধু তা-ই নয়, তিনি বিশ্বের সব শিশুর আইকন। ভালোবাসার মানুষ। যে নাম সব সময় নাড়া দিয়ে যায় সবার হৃদয়। যার বিরহে হু-হু করে ওঠে হৃদয়ের আঙিনা। সেই রাসেল বেঁচে থাকলে এখন ঊনষাট বছরে পা রাখতেন। আমরা নয়ন ভরে দেখতাম তাঁকে। তাঁর পদচারণায় কেঁপে উঠত মাঠ-ঘাট, রাজপথ। বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁরও অপরিসীম অবদান থাকত।

শেখ রাসেল বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে। শেখ রাসেল ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পরিবারের সবার খুব আদরের ছিলেন।

তাঁর জন্মগ্রহণের মুহূর্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।’

রাসেল নামকরণেরও একটি ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধুর বইপড়ার প্রচুর নেশা ছিল। বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত ছিলেন তিনি। তাই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা আগেই সিন্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের যদি ছেলে হয়, তাহলে শান্তির দূত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখবেন ‘রাসেল’।

শেখ রাসেল ছিলেন খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখতেন। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলেন। তবে তাঁর বেড়ে ওঠার প্রথম অংশে ছিল রাজনৈতিক সংকটের কাল। তারপর যুদ্ধে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর। বাবার জন্য তাঁর প্রচণ্ড কাতরতা ছিল। বাবা পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর জেদ ছিল তিনি বাবার কাছে যাবেন। তিনি বহু বার জেলে গিয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। শেখ রাসেল তাঁর চিরসঙ্গী সাইকেল নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তাঁর সাইকেলটি ছিল পরিবারের অন্য সদস্যের মতোই প্রিয়। যেটি এখন তাঁর স্মৃতিকে বহন করে নীরব সাক্ষী হয়ে আছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির জাদুঘরে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তাঁর আদরের ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন। তাঁর লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বই থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘আব্বার সাথে প্রতি পনের দিন পর পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুব কান্না কাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল আব্বার বাসা জেলখানায় আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় চলে যাব। বেশ কষ্ট করে ওকে নিয়ে আসতে হত। তখন আব্বার মনের অবস্থা যে কি হত তা আমরা বুঝতে পারতাম।’

১৯৬৬ সালের ১৫ জুন কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’

শেখ রাসেলের জীবনের ইচ্ছা এবং তাঁর কোমল হৃদয়ের চাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকে তৈরি করত। ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল, যখন সে গ্রামে যেতো গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করত। সে কাঠের বন্দুক বানাত। শিশুদের জন্য মাকে বলতো কাপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কিনে দিতেন। বাচ্চাদের সে প্যারেড করাত।’ বঙ্গবন্ধু ছেলেবেলায় যেমন মানুষের দুঃখ দেখলে এগিয়ে যেতেন, শেখ রাসেলও বাবার মতো স্বভাব পেয়েছিলেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর জন্য অন্তপ্রাণ ছিলেন রাসেল। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিদেশ সফরেও গিয়েছেন।

বাবা-ছেলের সেই সুখ-সখ্য বেশি বছর স্থায়ী হতে পারেনি। শেখ রাসেলের বয়স তখন মাত্র এগারো বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। খুব ভোরে একদল বিপথগামী তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে। সেদিন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও’। ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব’। এক ঘাতক এসে ওকে বলল, ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।’ একটি সম্ভাবনাময় জীবনের নির্মম পরিণতি ঘটল।

শেখ রাসেলের নাম শুনলেই কানে বেজে ওঠে কচিকণ্ঠের মিনতি, ‘আমি মায়ের কাছ যাব’। তিনি আজ আমাদের মাঝে থাকলে আমরা আরও একজন মহান নেতা পেতে পারতাম। বাংলাদেশ আরও উন্নত হতে পারত। বাবার দেখানো পথে সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারতেন। আমরা তাঁকে হারালাম। সবাইকে হারালাম। পুরো একটি নেতৃত্বশীল পরিবার হারালাম। আমরা কী যে হারালাম, নিজেরাই হয়তো বুঝি না। আজ তাঁর ঊনষাটতম জন্মদিনে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক ও সাংবাদিক