লকডাউন, জনসচেতনতা ও কিছু প্রশ্ন

Looks like you've blocked notifications!

দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া এবং আক্রান্ত-সংখ্যা ও মৃত্যু হার বেড়ে যাওয়ায় গত ১ জুলাই থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন (বিধিনিষেধ) জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে এর মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। তবে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনের সুবিধার্থে ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করা হয় লকডাউন। মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক জারিকৃত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আরও জানানো হয়েছে, ২৩ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত আবারও সারা দেশে কঠোর লকডাউন বহাল থাকবে। করোনা সংক্রমণের হার প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে, করোনায় দৈনিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে।

একদিকে মৃত্যুতে বিশ্বে শীর্ষ দশে, অন্যদিকে করোনার প্রকোপ যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে পরিস্থিতি করুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলমান বিধিনিষেধ শিথিল করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গণপরিবহণ, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, শপিং মল, পশুর হাট সব খুলে দিলে আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে।

অন্যদিকে, করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুর, পরিবহণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী, হকার, কলকারখানা, দোকানপাট, শপিং মলে নিয়োজিত কর্মীসহ আরও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশে যাত্রীবাহী সড়ক ও নৌশ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ। দেশে মজুরিভুক্ত শ্রমশক্তি ২.৪২ কোটি, যার ৩৪.৫ শতাংশ অর্থাৎ ৮৩.৩২ লাখই দিনমজুর (তথ্যসূত্র : বিবিএস লেবারস ফোর্স সার্ভে ২০১৭)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে ২০২০-এ দেখা গেছে, সারা দেশে বিভিন্ন দোকানে নিয়োজিত আছে ১.৩৯ লাখ কর্মী। উপরন্তু যোগ হয়েছে করোনার বদৌলতে বিদেশফেরত ও চাকরিচ্যুত হয়ে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা প্রায় দুই কোটি জনগোষ্ঠী। গত ৭ জুন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনায় করোনার প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, যা বিবিএস-এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে অনুমিত হিসাবে যা নেমে এসেছিল সাড়ে ২০ শতাংশে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। দিন এনে দিনে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো করোনায় গৃহবন্দি হয়ে তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে পারছে না।

লকডাউন শিথিলের প্রথম যৌক্তিকতা হচ্ছে, দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে না খেয়ে মারা যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। এই দুঃসময়ে একটি আশাব্যঞ্জক সংবাদ হচ্ছে, ঈদুল আজহা পালনের নিমিত্তে সরকার ইতোমধ্যে দরিদ্রদের জন্য ৩২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে এই প্রণোদনার আওতায় আনা এবং সরকারের একার পক্ষে এত সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব। তাই লকডাউনে যাদের আয় বন্ধ থাকে, তারা সাতটা দিন আয়-রোজগার করে পরবর্তী ১৪ দিন যেন অন্তত বেঁচে থাকতে পারে, সেজন্য বিধিনিষেধ শিথিলতার দিকে যাওয়া।

লকডাউন শিথিলের দ্বিতীয় যৌক্তিকতা হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও সচল করা। তৃতীয় যৌক্তিকতা হচ্ছে, শেকড়ের টানে গ্রামে ছুটে যাওয়া মানুষজনকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানো।

এ জন্য সরকারকে ভারসাম্য বজায় রেখে, আগে-পরে উভয় দিকেই ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন দিয়ে মাঝে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করতে হয়েছে, যাতে জীবন ও জীবিকা কোনওটার ওপরই বিরূপ প্রভাব না পড়ে। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সরকার নানামুখী পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু আমাদের নিজেদের অসচেতনতার দরুণ যদি করোনা সংক্রমণ বেড়ে যায়, সেই দায় আমরা কোনও ভাবেই সরকারের ওপর চাপাতে পারি না। কঠোর লকডাউনের ১৩তম দিনেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়ায় রাজধানীজুড়ে ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপি। বাসায় চা না বানিয়ে টং দোকানের চা পান করা কিংবা লকডাউন কেমন চলছে নিছক সেটা দেখার অজুহাতে বিধিনিষেধ অমান্য করে যারা বাসা থেকে বের হয়, তাদের মাঝে আত্মোপলব্ধি, আত্মসচেতনতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কঠোর, সীমিত, সর্বাত্মক লকডাউন কিংবা শাটডাউন, কোনো কিছুতেই করোনার সংক্রমণ বিস্তার আটকানো যাবে না।

করোনার প্রকোপ কমাতে লকডাউন নয়, জনসচেতনতাই আসল। আর স্থায়ীভাবে সমাধান পেতে হলে পরীক্ষা বাড়ানো, চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন ও যত দ্রুত সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিকল্প নেই।

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘উটপাখি’ কবিতায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ যে লোকটি শুধু এটা দেখার জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছে যে লকডাউন কেমন চলছে, সে তো অন্ধ বটেই, যে ঘরে চুপটি মেরে বসে থেকে ভাবছে তার মতো সুরক্ষিত ব্যক্তি আর কেউ নেই, সেও অন্ধের মতোই আচরণ করছে। কেননা ঘরে বেশিদিন বসে থাকা যায় না, জীবিকার তাগিদে ঘর হতে বাইরে পা বাড়াতে হবেই আর বের হওয়া মানেই করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি নেওয়া। একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের এই মহামারির ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে। আমাদের ধীরে ধীরে নিউ নরমালে অভ্যস্ত হতে হবে। সুতরাং, আসুন আমরা একটু সচেতন হই। মাস্ক পরিধান করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হই, করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং অন্যকেও মানতে উদ্বুদ্ধ করি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়