শেখ মনি : বাংলাদেশের নির্মাণ-প্রকৌশলী

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। আর প্রথম অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ভারত সরকার মুজিব বাহিনীকে একটি সি-৪, একটি এন-১২ এবং একটি পুরোনো ডাকোটা বিমান প্রদান করে। কারণ, মুজিব বাহিনী জানত, যুদ্ধে জিততে হলে চাই চতুর্মুখী আক্রমণ। ইতিহাস বলে, বিমানবাহিনী গঠনের কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

চতুর্মুখী আক্রমণের এই দূরদর্শিতার পেছনের মানুষটির নাম শেখ ফজলুল হক মনি। শুধু যুদ্ধের দিনের জন্য নয়, গেরিলা যুদ্ধ বা বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত সার্বভৌমত্ব, শাসনতন্ত্র ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই একটি সক্রিয় জনশক্তি বা জনগণের বাহিনী।

এ জন্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের ধারণার উন্মেষ ঘটে। সেই নিউক্লিয়াসের প্রাণপুরুষ শেখ মনি। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সবখানেই এই চিন্তার জয় আমরা দেখেছি। একাত্তর-পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই নানা বিরোধ-বিভ্রান্তি পাঠ করে, সেই সময়ে এমন একটি সক্রিয় শক্তির প্রয়োজনীয়তা এখন আমরা আরো বেশি করে অনুভব করতে পারি।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা, ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান এবং সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতির কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

মুজিব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি শেখ মনিকে কখনোই ভোলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং স্বদেশ নির্মাণে তাঁর যে ভূমিকা, ইতিহাস তার মূল্যায়ন করবে।

আমরা শেখ মনিকে জানি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এ দেশে যুব-রাজনীতির সূচনা করেন। যুবলীগের প্রথম চেয়ারম্যানও শেখ ফজলুল হক মনি।

কিন্তু এর আগে ষাটের দশক থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে তিনি মামলায় জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

পরবর্তীতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করলেও যুগপৎ তিনি তেজগাঁও আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, লেখক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত গল্পের সংকলন ‘বৃত্ত’ ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্প্রতি সংকলনটি আবারও প্রকাশিত হয়েছে ‘গীতারায়’ নামে। এ সংকলনের ‘অবাঞ্ছিত’ গল্পটি নিয়ে টেলিফিল্মও হয়েছে। শিশু-কিশোরদের সংগঠন শাপলা কুঁড়ির আসরের তিনি প্রতিষ্ঠাতা।

শেখ মনি একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যোগ্য পতাকাবাহক। আমরা জানি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির নির্মাণে, যাঁরা সম্মুখসারিতে কাজ করেছেন, তাঁরা প্রধানত ছাত্র-যুবা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রধানত ছাত্র-যুবারাই আন্দোলন করেছেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে নিজের জন্মভূমিতে ফিরে তাঁরা দেখতে পান শকুনির ধ্বংসযজ্ঞ। একদিকে স্বজনের লাশ, হাজারো নির্যাতিত নারী, গৃহহীন, সহায়সম্বলহীন অসহায় মানুষ; অন্যদিকে, রাজাকার-আলবদরসহ সুবিধাবাদী কিছু মানুষের উল্লম্ফন। এ পরিস্থিতিতে ছাত্র-যুবা-তরুণদের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু ঠিক সে সময়টিতেই তাঁদের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের দায়িত্ব দেন শেখ মনির হাতে। গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। যুবলীগের প্রধান লক্ষ্য ছিল, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায্যতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যুবলীগের কার্যক্রম দেখলেই বোঝা যাবে, এর প্রধান কার্যক্রম ছিল বাংলাদেশ নির্মাণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর অন্য স্বাধীন দেশ থেকে আলাদা। বাংলাদেশে একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং একই সঙ্গে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব অর্জন, উভয় কাজই হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশ নির্মাণে যুবশ্রেণির সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছিল অপরিহার্য। বিশ্বের বিভিন্ন নতুন দেশে বিপ্লব বা স্বাধীনতার পর এমন ভূমিকাই নিয়েছে সে দেশের তরুণ-যুবসমাজ।

শেখ মনির নেতৃত্বে তিন বছর যুবলীগও সেই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর থেমে যায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ, থেমে যায় এই প্রক্রিয়ায় যুবসমাজের অংশগ্রহণ।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি, একইভাবে তাঁর আদর্শের সৈনিক শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন সেই বাংলাদেশের নির্মাণ-প্রকৌশলী। রাজপথের সৈনিক, রণাঙ্গনের যোদ্ধা, গণমাধ্যমের কলমসৈনিক কিংবা সাহিত্যিক অথবা সংগঠক, যেভাবেই বলি না কেন, মাত্র ৩৬ বছর জীবনকালে শেখ মনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা বাঙালি জাতি কোনোদিন ভুলতে পারবে না।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, বিইউপি; সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ