কপ সম্মেলন : দ্বিতীয় পর্ব

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল : বিশ্বমানবের কল্যাণে নিভৃতচারী আত্মপ্রত্যয়ী নারী

Looks like you've blocked notifications!

কপ সম্মেলনের প্রথম দিনে সকালের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন বিশেষ কয়েকটি মিটিংয়ে উপস্থিত হতে রওনা করলেন, ঠিক তখনই আমি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আসি।

কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম প্যাভিলিয়নের ভেতরের কক্ষে অনেক লোকের আনাগোনা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ থেকে একজন বলল, পুতুল আপা এখানে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করছেন। একটু বোঝার চেষ্টা করলাম এবং এটুকু বুঝতে দেরি হলো না যে সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান জানানোর জন্যই তেমন কোনো কারণ ছাড়াই পুতুল আপার মিটিং রুমে একটু পর পর ঢুকছেন এবং বের হচ্ছেন। যদিও আমাদের দেশের কালচারে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে বিদেশিদের সাথে মিটিংয়ে বিষয়টি দৃষ্টিকটু লাগছিল। কিন্তু পুতুল আপা উনার স্বভাবগত ভদ্রতার কারণে কাউকে কিছু বলতে পারছিলেন না। আর লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, উনার সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা এসএসএফের সদস্যদের মিটিং রুমের পাশে না দেখতে পাওয়ার কারণে আমি বুঝে নিলাম যে মিটিং চলাকালে আর কাউকেই রুমে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।

আমি দ্রুত মিটিং রুমে ঢুকলাম এবং পুতুল আপার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো যে মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কেউ রমে ঢুকতে পারবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় অনেকেই জেনে গিয়েছেন যে পুতুল আপা এখানে আছেন। একে একে অনেকই আসলেন আর অনুরোধ করতে শুরু করলেন একবার শুধু সালাম দেবেন পুতুল আপাকে। বিনয়ের সাথে সবাইকে বুঝিয়ে বললাম এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শুধু শমী কায়সার আপুকে সালাম দেওয়ার সুযোগ করে দিলাম।

এতক্ষণে ঘড়ির কাঁটা বিকেল ৪টায়, সামনে দাঁড়ানো দুজন বিদেশি ভদ্রলোক, সাথে টিভি ক্যামেরা। আমাকে জানালেন যে পুতুল আপার সাথে তাদের পূর্ব নির্ধারিত শিডিউল রয়েছে। আমি উনাদের ১০ মিনিট পরে আসতে বললাম এবং যথারীতি ১০-১৫ মিনিট পর উনারা আবার আসলেন। উনাদের বাইরে রেখে আমি পুতুল আপার মিটিং রুমে ঢুকলাম এবং অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কথা জানালাম, উনি ততক্ষণে পূর্বের মিটিংয়ের শেষ প্রান্তে এবং আমাকে জানালেন উনি ১০ মিনিটের একটি ছোট ব্রেক নিতে চান। আমি উনার অনুমতি নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে থেকে সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু চেয়ে নিই এবং ১০ মিনিট অপেক্ষা করার জন্য বলি। উনারা আমাকে তিনটি প্রশ্ন লিখে দিলেন এবং আমি পুতুল আপাকে প্রশ্নগুলো দিলাম এবং উনি ২-৩ মিনিট নীরব থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি সাক্ষাৎকার কোথায় দেবেন, আমি বললাম, মিটিং রুমে আছেন ওই রুমে দিলেই ভালো হবে। উনি আমাকে বললেন, বাইরের ওপেন স্পেসে কেন করা যাবে না, আমি কয়েকটি কারণ বললাম এবং উনি ওই মিটিং রুমে বসেই সাক্ষাৎকার দেওয়ার সম্মতি দিলেন।

সাংবাদিক আর ক্যামেরা ক্রুদের জানাতেই উনারা ভেতরে আসলেন। সবকিছু ঠিক করে সাক্ষাৎকার শুরু করলেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয়বার চিন্তা করে দিতে হয়নি। উনার আত্মবিশ্বাস এমন ছিল যে নিজের কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন উনার চোখের মধ্যে ফুটে উঠেছিল নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদের কথা। মনে হচ্ছিল উনি বিশ্বের প্রতিটি বাস্তুচ্যুত মানুষের এক একটি কষ্টের গল্প তুলে ধরছেন সবার সামনে।

যথারীতি সাক্ষাৎকার শেষ হলো এবং ঘড়িতে ততক্ষণে বিকেল ৫টা। আমি জানতে চাইলাম, উনি দুপুরের খাবার খেয়েছেন কি না। বললেন সময় পাননি।

আমি জানতে চাইলাম কিছু নিয়ে আসব কি না। উনি বললেন একটু হাঁটতে চান আর সেই সাথে কিছু স্ন্যাকস খাওয়া যেতে পারে। আমি বললাম বাইরে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী অপেক্ষায় আছেন, আপনি চাইলেও দ্রুত বের হয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে।

উনি বললেন সবার সাথে কথা বলে যাব, তবে সবাইকে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে হবে। আমি শমী কায়সার আপুর সাহায্য নিলাম এবং মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সবাই লাইন করে দাঁড়ালেন। পুতুল আপা বের হলেন এবং সবার সাথে ধৈর্য সহকারে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বললেন। তার পর আমি আর পুতুল আপা হাঁটা শুরু করলাম।

আমরা কফিশপে গিয়ে কফি নিলাম, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম অনেক সময়। তার পর উনি রওনা হলেন উনার হোটেলের উদ্দেশে।

দ্বিতীয় দিন সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রোগ্রাম ছিল স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নে। আমরা সবাই গিয়ে ওইখানে উপস্থিত হলাম। প্রোগ্রাম শুরুর একটু পর গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন পুতুল আপা। উনাকে সামনের সারিতে একটি চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা করলেন স্কটল্যান্ড প্যাভিলিয়নের কর্মকর্তারা। মনোযোগ সহকারে পুরো মিটিং জুড়ে সবার বক্তব্য শুনলেন পুতুল আপা।

প্রোগ্রাম শেষ হতেই সবাই ছুটলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অন্যান্য মিটিংয়ের উদ্দেশে। যাবার পথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিদর্শন করলেন বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন।

এরই মধ্যে কেউ একজন পুতুল আপাকে কয়েকটি বই দিতে চাইলে পুতুল আপা আমাকে ডেকে বললেন বইগুলো আমার কাছে রাখতে এবং যাবার সময় যাতে মনে করে বইগুলো উনাকে দিই। তারপর উনি হাঁটতে শুরু করলেন। আমি কিছুক্ষণ হাঁটার পর জানতে চাইলাম আমি থাকব কি না, উনি বললেন থাকার জন্য।

এক এক করে পুতুল আপার সাথে অনেকগুলো প্রোগ্রামে উপস্থিত হলাম। বিশ্বনেতাদের সাথে উনার যে সম্পর্ক তা আমাকে বিস্মিত করেছে। সবাই হাসিমুখে প্রতিটি প্রোগ্রামে উনাকে স্বাগত জানালেন। প্রিন্স চার্লস, বরিস জনসন, বিল গেটস, জন ক্যারিসহ বিশ্বের প্রায় সব নেতাদের সাথে উনার যে নিবিড় সম্পর্ক, তা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

কয়েকটি প্রোগ্রাম শেষ করতেই ঘড়িতে প্রায় ২টা বেজে গেছে। পুতুল আপা আমাকে বললেন উনার একজন বন্ধু এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সহযোগী কর্মকর্তা উনাকে খুঁজে পাচ্ছেন না, যদি সম্ভব হয় তাহলে খুঁজে বের করতে। যদি সম্ভব হয় বলার কারণ হলো এই কনফারেন্স-স্থলের জায়গা এত বিশাল যে কেউ যদি হাঁটতে থাকেন তাহলে খুঁজে বের করা কঠিন। একসাথে প্রতিদিন ৩৮ হাজার লোক হেঁটে প্রবেশ করেন কনফারেন্স-স্থলে। বিশাল এলাকায় কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন বিধায় পুতুল আপা উনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর অবস্থান কোথায় এবং সেই প্যাভিলিয়নের উদ্দেশে রওনা হলেন। তার পরও অনেকক্ষণ লেগে গেল উনাকে খুঁজে পেতে। আমার সাথে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার পর আমাকে বললেন উনি আর হাঁটতে পারবেন না, কারণ সকাল থেকে একসাথে কয়েক কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এদিকে দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে, পরে আবার উনার মিটিং আছে। আমরা অনেক খুঁজে কোথাও বসার জায়গা পেলাম না, প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্টে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।

হঠাৎ দেখলাম একজন সিকিউরিটি অফিসার একটা চেয়ারে বসে আছে এবং চারদিকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম এবং সাথে সাথে উনি আমাকে চেয়ারটা দিলেন। আমি পুতুল আপাকে বসতে বললাম এবং আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড়ানোর পর আমি কাউন্টারে এসে খাবার অর্ডার করলাম। পুতুল আপা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন আমি যেন উনার জন্য মাছ বা সবজিজাতীয় খাবার নিয়ে আসি।

আমি খাবার নিয়ে আসলাম এবং এর পর যা হলো তা অবিশ্বাস্য। পুতুল আপা চেয়ার থেকে উঠে আমাকে বললেন, তুমি অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলে, এখন তুমি একটু বসো। আমি হতবাক হয়ে তাকালাম উনার দিকে আর বললাম, আপা এটা কি কোনোদিন সম্ভব যে আপনি দাঁড়াবেন আর আমি বসব আপনার সামনে। দয়া করে আপনি বসেন। তার পর আমরা খাবার খেলাম, সিকিউরিটি অফিসার কেউ কাছে আসছেন না কিন্তু দূর থেকে আমাকে বার বার বললেন যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, পুতুল আপার পরের মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। আমি আপাকে বললাম উনার পরবর্তী মিটিংয়ের কথা। উনি বললেন, ঠিক আছে, তবে খাবার নষ্ট করা যাবে না। আমরা একটি ব্যাগে করে খাবারগুলো নিলাম।

পরবর্তী মিটিংয়ে যেতে যেতে আমাকে বললেন, উনার বন্ধুর সাথে কয়েকটি ছবি ওঠাবেন, আমি যেন মিটিং শেষে ছবিগুলো উঠিয়ে দিই। উনার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগটি ছিল, আমি অনেক বার অনুরোধ করে বললাম ব্যাগটি আমার কাছে দেওয়ার জন্য। উনি বললেন, আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি। তাছাড়া আমার ব্যাকপ্যাক তুমি কাঁধে নেবে, এটা দৃষ্টিকটু দেখায়।

আরও অনেক বিষয়ে আলাপ করলেন, বাচ্চাদের খবর নিলেন, এলাকার খবর নিলেন, দেশকে নিয়ে উনার বিভিন্ন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বললেন এবং বিশেষ করে উনার জীবনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় জিনিস আমাকে জানালেন, আমিও অভিভূত হয়েছি এবং শিখেছি অনেক।

সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাকে আবেগতাড়িত করেছে সেটা হলো একজন বাঙালি নারী হয়ে কতটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে উনাকে আজকের এই জায়গায় আসতে, সেই যাত্রাপথ কতটা কণ্টকপূর্ণ ছিল তা আমাকে বোঝালেন। তবে যে বিষয়টি উনি কথা বলতে চাননি তা হলো রাজনীতিতে উনার আগ্রহ বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি, যদিও আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম কয়েক বার।

মিটিং শেষে উনার ছবি তুলে দিলাম এবং তার একটু পরেই আমি বহির্গমন গেট পর্যন্ত হেঁটে বিদায় জানালাম এবং উনি চলে গেলেন হোটেলের উদ্দেশে।

তৃতীয় দিন সকাল বেলা কনফারেন্স ভেন্যুতে আসতে আমাদের একটু দেরি হয়েছে যেহেতু মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়রা গিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানাতে।

আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম পুতুল আপা ইতোমধ্যে এসে একটি মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। আমি ওই মিটিং রুমে ঢুকতেই উনি মঞ্চ থেকে মৃদু হেসে আমার উদ্দেশে হালকা হাত নাড়েন। আমি একটু পরই সামনে এগিয়ে গিয়ে উনার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি নিলাম।

মিটিং শেষ করে পুতুল আপা আরও কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিলেন এবং উনার বিনম্র কথার মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ শব্দচয়নে সাংবাদিকেরা উদ্বেলিত হয়েছেন।

সবকিছুর পর একটি জিনিস সত্য আর সেটা হচ্ছে রক্ত কথা বলে। আল্লাহর অশেষ নিয়ামত বঙ্গবন্ধুর ওপর ছিল এবং উনি ৭ কোটি বাঙালি থেকে আলাদা কিছু গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন বিধায় উনার নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। আর তারই রক্তের ধারা বহমান তাঁর বংশের প্রতিটি মানুষের শরীরে।

আজ ৯ ডিসেম্বর, পুতুল আপার জন্মদিন। দোয়া করি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন উনাকে জানার সুযোগ পান। আপনারা সবাই উনার দীর্ঘায়ু ও কল্যাণময় জীবন কামনা করে দোয়া করবেন। শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধেয় সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আপা।

লেখক : তরুণ উদ্যোক্তা ও রাজনীতিক