বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

সুন্দর ও সুস্থ বিশ্ব গড়তে চাই বৈষম্যমুক্ত স্বাস্থ্যখাত

Looks like you've blocked notifications!

আজ ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্বব্যাপী দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য—Building a fairer, Healthier world. অর্থাৎ একটি সুন্দর এবং সুস্থ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।

আমরা জানি, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব স্বাস্থ্যখাতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আমাদের সারা বছর যেমন কিছু অসংক্রামক ব্যাধি থাকে, সঙ্গে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি, যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব হুমকির সম্মুখীন; যেমন—কোভিড-১৯-সহ কয়েক বছর আগে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ইবোলা। একদিকে ধনী-গরিবের বৈষম্য, অন্যদিকে দরিদ্র গোষ্ঠী এই করোনাকালে আরও বেশি কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে। গ্রামের অনেকেই আছে, যারা সঠিক পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছে না এবং তাদের যে মৌলিক চাহিদা, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটাইজেশন ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে মহামারিকালে তাদের কষ্টের সীমা আরও বেড়ে গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস এমন সময় এসেছে, যখন বাংলাদেশে করোনার কারণে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলছে সরকার। সুতরাং আমাদের এই দিবসের যে প্রতিপাদ্য বিষয়, তা হলো দেশের মানুষকে সচেতন করা, বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। আমরা দেখছি, অনেকেই আছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। আমরা এই অবস্থায় কোভিডকালে আজকের যে স্বাস্থ্যখাতের চ্যালেঞ্জগুলো থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি, সেই বিষয়গুলো এই দিনটি উদযাপনে নতুন করে ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবারও বলছি যে কোভিড-১৯-কালে অনেকেই আছে, তারা হয়তো উন্নত জীবনযাপন করছে, যারা স্বাস্থ্যখাতের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে; কিন্তু দেশের একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তাদের যে স্বাস্থ্যখাতের মৌলিক চাহিদা, তা তারা ভোগ করতে পারছে না। তাদের অপুষ্টি, তাদের মা ও শিশুস্বাস্থ্য, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরে যে মৃত্যুহার; এর সাথে প্রবীণ যাঁরা আছেন, তাঁদের যে স্বাস্থ্যখাতের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার, তা দিতে আমরা পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছি না। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়, এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা।

আমরা বাংলাদেশের সব মানুষকে কোভিড-১৯ টিকাদানের আওতায় আনতে পারিনি, খুব অল্প মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে পেরেছি, যদিও ৮ এপ্রিল থেকে কোভিড-১৯ টিকার দ্বিতীয় ডোজ শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা জানি, ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয় এবং ১১ মার্চ করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা দেয় ও ১৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আজ ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল করোনাকালের ৩৯৬তম দিনে এসে পৌঁছেছি। আমরা জানি, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির জন্য নানাভাবে সংগ্রাম করছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যখাতের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অর্থাৎ ধনী-গরিবের বৈষম্য ও সরকারি এবং বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য আমাদের দূর করা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্যের যেমন উন্নতি দরকার, শিক্ষারও তেমনই উন্নতি দরকার। কারণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার উন্নতি প্রয়োজন। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করায় যদিও কিছুটা উন্নতি হয়েছে, এর পরও বলব, এখনও আমরা পুরোপুরি উন্নতি করতে পারিনি। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হবে। যদিও আমাদের সরকার বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দিয়েছে, কিন্তু সেভাবে মানা হয়নি।
 
প্রথম দিকে যে আতঙ্ক-উদ্বেগ ছিল, সেটি থেকে মানুষ নতুন সাধারণ জীবনে পদার্পণ করেছে। এমন সময় করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে, আর ঠিক সেই সময় আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করছি। আমরা যদি এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে চাই, তাহলে এ বছরের যে প্রতিপাদ্য বিষয়—সুন্দর ও সুষ্ঠু পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে জনগণের একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসার যে মৌলিক চাহিদা, তা সরকারকে পূরণ করতে হবে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য এবং সংক্রামক ও অসংক্রামক যে ব্যাধি, সে বিষয়ে আরও ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যের যে অবকাঠামো, সেটা ভালো রয়েছে। আমাদের দেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বিশ্বের রোল মডেল। আমাদের শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়েছে, এমনকি আমাদের দেশে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী আসে, তাদের শিশুদের সব ধরনের টিকা দেওয়া ছিল না, বরং আমাদের দেশে আসার পর আমরা রোহিঙ্গা শিশুদের আমাদের দেশের শিশুদের ন্যায় টিকা প্রদান করেছি। এতে করে বাংলাদেশ টিকাদানে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
 
আমাদের দেশের অন্যান্য যে চিকিৎসা সুবিধা, যেমন হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারেনি হয়তো, মৌলিক কিছু চিকিৎসা দিচ্ছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশকে আমরা আধুনিক চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না। এটি স্বাস্থ্য খাতের একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা জানি যে স্বাস্থ্য রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর অনেক লোক হৃদরোগের কারণে মারা যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ ও লিভারের রোগ; এ রকম আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু কোনো হেলথ ইন্সুরেন্স নেই। তাই অনেকেই নিজের টাকায় আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারছে না। পাশাপাশি আমাদের দেশের ওষুধের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণ করতে অনেকেই নিজের টাকায় সক্ষম হচ্ছে না। এসব বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে।
 
২০২০ সালে করোনা আমাদের জীবনযাপনকে বদলে ফেলেছিল। আমাদের আপনজনকেও শেষ বিদায়টুকু দিতে সক্ষম হইনি। এটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টের। যাদের আপনজন না ফেরার দেশে চলে গেছে, তাদের সহানুভূতি দেওয়ার মতো ভাষা আমাদের নেই। এখনও যদি আমরা এ বিষয়ে সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আমাদের মৌলিক কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মানতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। সরকারকেও আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনতে হবে।
 
লেখক : হল প্রভোস্ট ও অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়