সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : শিল্পপথের সব্যসাচী

Looks like you've blocked notifications!

লুকিয়ে রাখা ধুলায় ঢাকা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিকে যদি শিল্পালোকের ঝর্ণাধারায় ধুয়ে দিতে বলি, তবে অনিবার্যভাবে এক আলোকবর্তিকা সামনে এসে তার দ্যুতি ছড়িয়ে যায়। ঘুমের জালে জড়িয়ে থাকা বুদ্ধিবৃত্তির কপালে যদি অরুণ আলোর সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিতে বলি, অনিন্দ্য বাতিঘর হয়ে সটান দাঁড়িয়ে যান এক ঋদ্ধিমান পুরুষ। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রাণের পুরুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি।

তাঁর পৈতৃক নিবাস আমাদের কুষ্টিয়ার গড়াইতীরের কয়া গ্রামে। এই সূত্রে সৌমিত্রের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে চিরায়ত মহাকাল। আর সেই মহাকালের অমর যাত্রী যখন তাঁর আবাস বদল করেন, আমরাও তাঁর স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে সমান বিয়োগব্যথা অনুভব করি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক পরিপূর্ণ জীবনযাপন করার পর সৃষ্টির কারিগর এই করোনাকালে তাঁর মহাপ্রয়াণের বিধিলিপি এঁকেছেন। আমরা সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই তাঁর অত্যুজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি।

খুব স্বাভাবিকভাবেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ পুরো শিল্পীসমাজ। বিশেষ করে যাঁরা এই দুই বাংলায় অভিনয়-সংশ্লিষ্ট, তাঁদের মাথার ওপর থেকে বিশাল ছাতাটাই হঠাৎ করে যেন সরে গেল—এমনটাই মনে করছেন শিল্পবোদ্ধারা।

জীবদ্দশায় সৌমিত্র একজন নিখাদ অভিনতা ছিলেন বটে; শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সৃজনশীল লেখালেখি, সাহিত্যপত্র সম্পাদনা, আবৃত্তিসহ সবমিলিয়ে শিল্পের বহুমাত্রিক সমুদ্রে অবগাহন করে জীবনবোধের রস বুঝে নেওয়ার চেষ্টাটাই করেছেন তিনি। তাঁর পাঠাভ্যাসও ছিল বিপুলবিস্তারি। কার্যত রুপালি পর্দায় যেমন সহজাত অভিনয় করেছেন, বাস্তব জীবনটাকেও করে রেখেছিলেন হৈচৈ ভরা আনন্দমুখর। মানুষ হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন নিরাভরণ, নির্মোহ অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন ততধিক ‘মিনিমালিস্টিক’। আর এভাবে অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল অভিনয়-সাধনা দিয়ে সৌমিত্র যে ঘরানা বিনির্মাণ করে গেলেন, তার উত্তরাধিকার এখন অনেক অনুবর্তী।

এই মহাশিল্পীর প্রয়াণে তাঁর শিল্পসতীর্থ সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী তাই আফসোস নিয়ে উচ্চারণ করতে পারেন, ‘তাঁর কার্যকলাপ, কথা বলা, হাসি; সবকিছু আমার মনে থাকবে। অনেক দিন পর্যন্ত মনে পড়বে তাঁকে। তিনি কাজের ফাঁকে গল্প বলে, জোকস বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন।’

শর্মিলা ঠাকুর বলেছেন, ‘তাঁর মতো কে আছে আর যে একই সঙ্গে সিনেমা করেছেন, থিয়েটার করেছেন, ছবি এঁকেছেন, আবৃত্তি করেছেন।’

আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী ববিতা লিখেছেন, ‘সৌমিত্রদা তো মানিকদার প্রিয়তম অভিনয়শিল্পী ছিলেন। সৌমিত্রদা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অভিভাবক। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে এক সৃষ্টিশীল অধ্যায় শেষ হলো। আমার হৃদয়ে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি, তাঁর মৃত্যু হবে না।’

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যদি আর কিছু নয়, শুধু বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের অপু বা ফেলুদা চরিত্র দুটিই চিত্রিত করতেন, তবু শিল্পের অমরত্বে অক্ষয় অবিনশ্বর হয়ে থাকতেন। ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে আমাদের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে সৌমিত্রের অসাধারণ রসায়ন আজন্ম আমরা মাথায় করে রাখব।

প্রিয় চরিত্র প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “আমাদের দেশে শিল্প-সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে তো বটেই, সাহিত্যেও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংকটেরই প্রাধান্য। সেখানে ‘অশনি সংকেত’-এর কাহিনির মধ্যে সমস্ত সমাজকে বিড়ম্বিত করেছিল এমন একটি ঘটনা মন্বন্তর, যা নাকি ভারতবর্ষের বুকে কত দিনের অভিশাপের মতো চেপে রয়েছে—তেমন একটা সামাজিক দুর্বিপাকের ছবি রয়েছে। স্বভাবতই এই কাহিনির নায়ক চরিত্র তাই একটা সামাজিক অবস্থার অত্যন্ত জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

একটা কথা বলা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এ রকম চরিত্র দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে যখন অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হই, তখন পঞ্চাশের মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি নিয়ে শুধু যে বইটই পড়ি, তথ্য সংগ্রহ করি, তা-ই নয়, এ ধরনের চরিত্র কেমন করে হাঁটে, কেমন করে বসে, তার কথার আঞ্চলিকতা কেমন, এসব খুটিনাটিও আমি বোঝার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিকতাও বোঝার চেষ্টা করি।

তপন সিংহ যখন আমাকে ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির ময়ূরবাহনের চরিত্রে নির্বাচন করেন, তখনো এই চরিত্রটিকে মনে মনে কল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রটির কিছু কিছু শারীরিক পটুতাও আমাকে অর্জন করার চেষ্টা করতে হয়েছিল। যেমন অশ্বচালনা।”

সৌমিত্রের অভিনয় কেন আমাদের আটপৌরে জীবনের সঙ্গে মিলে যায়, কেন মনে হয় এই তো আমাদের চেনা পড়শি, জীবনযুদ্ধে জয়ী পাড়াতো ভাই। সৌমিত্র এক বিস্ময়কর সাধনা বলেই দর্শক-ভক্তের মনের মুকুট হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, যে অপার আরশিতে সর্বমানুষ নিজেকেই দেখতে পায়।

৮৫ বছর বয়সে এক বর্ণাঢ্য জীবনের সমাপন ঘটল গত রোববার। নশ্বর দেহ মৃত্তিকায় লুটাল ঠিকই, তাঁর জীবনবোধের নক্ষত্ররাজি জ্বলজ্বল করবে অনন্ত মহাকাশে। কিংবদন্তি মঞ্চপুরুষ শিশির ভাদুড়ী এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহত্তম জীবনপথ রচনা করে দেয়। সত্যজিতের মাধ্যমেই চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রের। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, কেবল বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্র নয়, অভিনয়কুশলতা দিয়ে বিশ্ব শিল্পসমাজেরও এক বিস্ময়কর বাসিন্দা হয়ে উঠেছিলেন সৌমিত্র।

সত্যজিৎ রায় ছাড়াও খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষসহ অনেকের মুভিতেই অভিনয়-প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন তিনি। ৬১ বছরের দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ভারতীয় পদ্মভূষণ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, বঙ্গভূষণ, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা লিজিয়ন অব অনারসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাম্মানিক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

এমন একজন জীবনবাদী মানুষটি জীবনের পড়ন্তবেলায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ এ জন্য নেই যে অনিবার্য মেনে নেওয়াই তো সভ্যতা। বরং আমি মনে করি, আজ যে বৃদ্ধ হয়েছি, তারও একটা ভয়ংকর ভালো দিক আছে। এখন বুঝতে পারি, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আছে, আর দেশের মানুষ আমাকে যে ভালোবাসে, তা শুধু আমার অভিনয়ের জন্য। বাঙালি আমাকে মনে করে আমি তাদের ন্যাশনাল প্রাইড। এটা তো কম পাওয়া নয়, বরং বলতে পারেন এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

জাতপাত ধর্ম গোত্র বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষে মানুষে সম্মিলনের ঐন্দ্রজালিক উপলব্ধি তিনি বাল্যেই রপ্ত করেছিলেন। জীবনব্যাপী কর্মনিপুণতায় সেই বোধটারই পরিচর্যা করে গেছেন মাত্র। সৌমিত্রের প্রতি আমাদের সমস্বর ভালোবাসা সেই সাধনারই অমোঘ বিপ্রতীপ প্রতিবিম্ব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সমকালীন হয়েও তাঁদের বাইরে গিয়ে নিজস্ব স্টাইলে কাব্যচর্চা করেছেন সৌমিত্র। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে তাঁর ৮০০ পৃষ্ঠার কবিতা সমগ্রও বের হয়েছিল। কবিতার বাঁকবদলের বিপ্লব না হোক, কাব্যের প্রতি ধ্যানমগ্ন নিষ্ঠা না থাকলে এটা সম্ভবপর হতো না। ভীরুতাবিরোধী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাই দুর্দান্ত সাহস নিয়েই লিখে যেতে পেরেছেন :

কতগুলো ভীরু বারুদকে আমি

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঘেন্নায়

বোমা আর পাইপগান দিয়ে

ভীষণ চমকে দিয়েছিলাম।

যে জীবন আলোকিত। যে প্রাণ শুভবোধে উদ্ভাসিত। যে মন বহুবর্ণিল ছন্দময়তায় ভাস্বর। যে হৃদয় বৈশ্বিক মঙ্গলময়তায় পরিপূর্ণ। সেই জাদুকরি প্রাণের আনন্দধারা ও অবিনাশী কোমল হাওয়ায় আমাদের প্রাণান্ত প্রণতিটুকু যুগান্তরের জন্য রাখা থাক। সব ভক্তের সুন্দর মনন থেকে শিল্পপথের সব্যসাচী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াণ-পরবর্তী বেদনাবিধুর প্রভাতে তাঁর প্রতি রাবীন্দ্রিক এই নৈবেদ্যটাই সত্য থাকুক :

বিশ্বহৃদয় হতে ধাওয়া আলোয় পাগল প্রভাত হাওয়া,

সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও॥

লেখক : সাংবাদিক