ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট

স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব

Looks like you've blocked notifications!

রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব এখন এক নতুন মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী ‘অ্যালায়েন্স সিস্টেম’ ডেভেলপমেন্টের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করছে রাশিয়া কত দ্রুত কিয়েভ দখলে নিতে পারে তার ওপর। যদি কিয়েভের পতন দ্রুত হয় তাহলে পুতিন যে লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন তা সাফল্যের মুখ দেখবে বলেই মনে হচ্ছে এবং এতে একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো এড়ানো সম্ভব হবে।

কিয়েভ দখল বিলম্বিত হলে বিশ্বরাজনীতি ভিন্নমাত্রা লাভ করতে পারে। এতে পাশ্চাত্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সময় পাবে এবং পুতিনকেও তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হতে পারে। কেননা পুতিনের পেছনে ফিরে আসার রাস্তা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো যদিও প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এখনও শুরু করেনি, কিন্তু রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে তারা একপ্রকার যুদ্ধই শুরু করেছে বলা যায়। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে ফ্রান্স ইতোমধ্যে সাগরে পণ্যবাহী রুশ জাহাজ আটকে দিয়েছে।

বিশ্ব বর্তমানে দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ, ব্রিটেন; অন্যদিকে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবা প্রভৃতি। ভারত যদিও নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, তবে ঐতিহাসিক কারণেই সে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষেই থাকবে। পাকিস্তানও তাই করবে। আরব ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলো, মধ্য এশিয়া ও বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলো পরিস্থিতি বুঝে যেকোনো সময় যেকোনো দিকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে। এসবই নির্ভর করছে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ রুশ আক্রমণের মুখে কতক্ষণ টিকে থাকে তার ওপর।

রাশিয়ার আকস্মিক এই উত্থান মার্কিন নীতিতে বিক্ষুব্ধ ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে উৎসাহী করে তুলেছে। রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর ন্যাটো কৃষ্ণসাগর এলাকা থেকে তার যুদ্ধজাহাজ সরিয়ে নেয়। তাছাড়া ন্যাটো কর্তৃক ইউক্রেনকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুত প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তাদানে অস্বীকৃতি সেই বলয়ের দুর্বলতা স্পষ্ট করে তুলেছে এবং এর ফলে পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থাহীনতা প্রবল হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে রাশিয়ান জোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক হবে, তা তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপের প্রয়োজনীয় জ্বালানি, বিশেষ করে তেল ও গ্যাসের বৃহত্তম যোগানদার হলো রাশিয়া। সুতরাং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কতটুকু কার্যকর হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাছাড়া কিয়েভের পতন না হলেও ইউক্রেন মূলত রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়ায় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য খাদ্যসংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ইউক্রেনকে বলা হয় ইউরোপের রুটির ঝুড়ি।

একটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হলে ক্রিমিয়া ও বেলারুশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকায় ন্যাটোর স্থলসৈন্যের পক্ষে রাশিয়া আক্রমণ করাও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যদি কিয়েভের দ্রুত পতন ঘটে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো একটি বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকিতে না যায় তাহলে এটি নিশ্চিত যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কাঠামোতে ব্যাপক রদবদল হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব আবার একটি স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বরাজনীতির ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ইউরোপ থেকে ইউরেশিয়ায় চলে আসতে পারে এবং বিশ্বে মার্কিন যুগের অবসানের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। ফলে রাশিয়ার প্রভাবে চীন-ভারত-পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

রাশিয়া ইউক্রেনকে দিয়ে তার অভিযান শুরু করলেও এতেই সে থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা, পুতিন ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছেন যে তিনি রাশিয়ার পূর্বের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। সে ক্ষেত্রে বাল্টিক অঞ্চলের পূর্বের সোভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে (যেমন লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া) ন্যাটোর প্রভাব শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। জাপান ও জার্মানি যদিও পাশ্চাত্যের শক্তিবলয়ে অবস্থান করছে। কিন্তু তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে গিয়েছে বলে মনে হয় না।

লেখক : বিভাগীয় সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়