স্যারের প্রিয় ফুল ও কিছু কথা

Looks like you've blocked notifications!

১.

অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন, আমাদের প্রাণের প্রাঙ্গণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। গোলাম হোসেন স্যার ২০১২ সালের ৩০ জুলাই সন্ধ্যায় মারা যান। আমাদের শিক্ষকের আকস্মিক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যুদিবসটি বেদনার কালো মেঘ নিয়ে আসে মনের আকাশে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. গোলাম হোসেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার তরগাঁও গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরার পথে আশুলিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেদিন রাত ৯টায় জাবি ক্যাম্পাসের নিজ বাসায় যাওয়ার পথে আশুলিয়ার মরাগাঙ এলাকায় একটি ট্রাক তাঁর গাড়িকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। পরে তাঁকে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অবস্থার অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালের ১৩ জুন অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন জন্মগ্রহণ করেন।

২.

রাজনৈতিক, আদর্শিকসহ অসংখ্য বিষয়ে মতান্তর থাকা আমার প্রিয় অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন স্যারের সঙ্গে অজস্র স্মৃতি মনে পড়ছে। ২০১২ সালের জুনে স্যার যখন অসুস্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন বেশ কয়েকবার স্যারের সঙ্গে দেখা করি, স্যারের প্রিয় ফুলও সঙ্গে নিয়ে যাই। সেই ফুল পেয়ে শিশুর মতো আনন্দিত স্যারকে দেখে মনটা আমার খুশিতে ভরে গিয়েছিল; আজও সে স্মৃতি মনে পড়লেই কষ্ট মিশ্রিত সুখ অনুভব করি। উল্লেখ্য যে, ১৯৯২ সালে আমি যখন এই বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হই, ড. গোলাম হোসেন স্যারই ছিলেন বিভাগীয় সভাপতি। আর আমি বিভাগের যে শিক্ষকের সঙ্গে প্রথম পরিচত হই, তিনি ড. গোলাম হোসেন। বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তাঁর কাছে আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন সোহেল ভাই, যিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র এবং সেইসঙ্গে সাংবাদিকতাও করতেন। ফলে আমার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কারণে প্রথম দিনই অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন স্যারের সঙ্গে পরিচিত হই, চা-পানে আপ্যায়িত হই। সেই মধুর স্মৃতি আজও সমুজ্জ্বল আমার মনের আকাশে।

৩.

অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি ছিলেন বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। দৈনিক ভোরের কাগজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বহুবার তাঁর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। তাঁর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মনোভাবের নানাবিধ তাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি ক্ষুব্ধ হননি, ছাত্রের বিপরীত মতকে অসম্মান করেননি। যদিও নানা কারণে জাবি ক্যাম্পাসে গোলাম হোসেন স্যার বহুল আলোচিত হয়েছিলেন তাঁর শিক্ষকতাকালে। সেই বিতর্ক এড়িয়ে শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের বাইরের তাঁর সঙ্গে আমার মুক্তবুদ্ধি চর্চায়, সতর্ক বিতর্কে সময় কাটানোর প্রীতিময় স্মৃতির আলোকে স্যারকে স্মরণ করছি কৃতজ্ঞতায়। প্রচলিত অর্থে ‘রাগী পুরুষ’ স্যারের সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে দ্বিমত ছিল, প্রকাশও করতে পারতাম, কিন্তু তাতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘাটতি পড়েনি। তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ, মতান্তর হয়েছে, কিন্তু মনান্তর হয়নি।

৪.

ড. একেএম গোলাম হোসেন ১৯৫৪ সালের ১৩ জুন ঢাকার উপকণ্ঠে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার তরকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা মরহুম মোহাম্মদ আলাউদ্দীন। গোলাম হোসেন স্যারের কৈশোরকাল অতিক্রান্ত হয়েছে ১৯৬৬ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সক্রিয়তায়। অবশেষে ১৯৭১ সালের দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন তিনি। ছাত্র জীবনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাক্ষরও রাখেন তিনি। সদা প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব গোলাম হোসেন স্যার ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হন। এবং এই ঘটনার রেশ ধরে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তিনি হন এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ভাগ্যবান এই যুবক লাভ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদ এবং সাহচর্য। তাই বলে তিনি লেখাপড়ার প্রতি তীব্র আগ্রহ হারিয়ে ফেলেননি। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য চলে যান ভারতের জয়পুর। জয়পুরের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক শাসন বিষয়ে তাঁর পিএইচডি গবেষণা কার্যক্রম সমাপ্ত করার পর অবশেষে ১৯৮৪ সালে তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময় তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রভোস্ট, বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৫.

অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন যার অধিকাংশ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির ওপর। এ ছাড়া দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত অনুচ্ছেদসমূহও ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। ১৯৮৪ সালে তিনি ভারতের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিও নিয়েছেন বাংলাদেশ ‘জাতীয়তাবাদী দল: একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ’ বিষয়ের ওপর। অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর তাঁর ত্রিশটির অধিক গবেষণাপত্র দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন তাঁর বই ও গবেষণাপত্রের মাধ্যমে। অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেনের লেখা বইসমূহের মধ্যে রয়েছে—জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি: একটি সামরিক শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ট্রান্সফরমেশন (১৯৮৮), সিভিল বাংলাদেশে সামরিক সম্পর্ক: একটি তুলনামূলক স্টাডি (১৯৯১), বাংলাদেশ: সরকার ও রাজনীতি (১৯৯২), স্থানীয় শাসন এবং বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস (২০০৭)। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে—গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুর। অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ১৯৯২-১৯৯৩ সেশনে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারের গর্ভনিং বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৯২-১৯৯৬ সেশনে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ছিলেন।

৬.

অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন ১৯৯২ সালের জুলাই থেকে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৯০ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি জাবির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি জাবির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৮৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৮৬-১৯৯৭ সেশনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হেইদেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশের রাজনীতি এবং উন্নয়ন বিষয়ে কোর্স করিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি SOAS in London, Kobe Gakuin University in Japan, Berlin Humboldt, Erfurt and Freiburgh Universities in Germany, Rajasthan University in India and Connecticut University at Storrs in the USA বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

৭.

আবারও স্মৃতিচারণ না করে পারছি না। সাংবাদিকতা ও অন্যান্য কারণে স্যারের ক্লাস খুব কম করেছি, কিন্তু তাঁর ভালোবাসার দরজা আমার জন্য সবসময় খোলা ছিল বলে সময়ে-অসময়ে গিয়ে হাজির হতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপনে এমনকী তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতা করেও কথা বলতাম। স্যার আমার বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ চাইতেন। যথাসমসয়ে সে সব স্যারকে দিতাম বলে কেবল ছাত্র হিসেবে স্নেহই নয়, বন্ধুসুলভ প্রীতির মাত্রাটাও আমার প্রতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তাঁর এক সহোদর আমার ক্লাসমেট ছিল এবং একই কামালউদ্দিন হলে থাকতাম বলে স্যারের বাসায়ও অনেকবার গিয়েছি, ভাইয়ের মতোই স্বজনপ্রীতি ধন্য হয়েছি।

৮.

আমাদের প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাচর্চার অন্যতম অধিক্ষেত্র সরকার ও রাজনীতি বিভাগের যশস্বী অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম হোসেন স্যারের সঙ্গে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অধীনে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের বিএনপি গড়ে তোলা, বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ অঞ্চলের প্রভাব, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিষয়সহ নানাবিধ প্রসঙ্গে আলাপন-বিতর্কের আলোকিত সময়গুলোর স্মৃতি আজ খুব মনে পড়ছে। আর তীব্রভাবে অনুভব করছি তাঁর মতো আলাপচারী শিক্ষকের অনুপস্থিতি।

 লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাসানটেক সরকারি কলেজ।