স্মরণ
আজকের বাংলাদেশ ও জিয়া প্রদর্শিত রাজনৈতিক সংস্কার
ক. রাজনৈতিক শৃঙ্খলা একটি বাঞ্ছিত ব্যবস্থা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই বাঞ্ছিত ব্যবস্থার পরিবর্তে অস্থিরতা, অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতা সমাজজীবনের অনিবার্য অনুসঙ্গ। এর কারণ হচ্ছে স্বাধীনতা-উত্তর শাসক এলিটরা একটি বাঞ্ছিত ‘রাষ্ট্রীয় কাঠামো’ এবং কাঙ্ক্ষিত ‘জাতি গঠনের’ পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে অথবা আঞ্চলিক প্রভুত্বের দাপটে কৃত্রিম ও আরোপিত ব্যবস্থাদি প্রয়োগ করেন। তাদের অন্যায়, অনাচার, অদক্ষতা, অযোগ্যতা দুর্নীতি ও দুঃশাসন সমাজজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। ভায়োলেন্স, সশস্ত্র তৎপরতা, নিয়মতান্ত্রিক অথবা অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন এবং অবশেষে সামরিক অভ্যুত্থানের মতো বিষয় ওই সব ঘটনাবলির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফসল। এমনি একটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে জিয়াউর রহমান বাঞ্ছিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অতীতকে বিশ্লেষণ করে জিয়াউর রহমান বুঝতে সক্ষম হন যে : Òpolitical order depends in part or relation between the development of political institutions and mobilization of social forces” (Huntington: 1968:7)। তাই সঙ্গতভাবেই তিনি যথার্থ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্তর্নিহিত সামাজিক শক্তি সমন্বয়ে প্রয়াসী হন। গতানুগতিক রাজনৈতিক প্রথা পদ্ধতি এবং শাসন কাঠামোতে পরিবর্তনের সূচনা করেন। এভাবেই তিনি অতীতের দুঃশাসনকে সুশাসনে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন।
খ. এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিগত চার দশকে জিয়াউর রহমান ছিলেন তাৎপর্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমরবিশারদ। মুক্তিযুদ্ধের ওই দুঃসময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তাঁর কুশলতা, সৃজনশীলতা এবং বীরত্ব সন্দেহাতীতভাবে জাতিকে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করে। ক্ষমতা গ্রহণের পর যথার্থভাবেই তিনি জাতির নাড়ির অনুভূতি অনুধাবনে সক্ষম হন (চৌধুরী, হাকিম, জাফরুল্লাহ: ১৯৯৬:২৫)
জাতির আদর্শ বিশ্বাস এবং জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, বাস্তবসম্মত, প্রায়োগিক সংস্কার সাধন করেন। সংস্কারসাধনে তিনি ছিলেন সতর্ক সাবধানী। তিনি এ ক্ষেত্রে অতিবাস এবং অতিজন থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখেন। বস্তুত তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী। তাঁর অনুসৃত নীতি-আদর্শের প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন এবং তাঁর সংস্কার বহমান থাকার কারণ হিসেবে সমাজতত্ত্ববিদরা তাঁর মধ্যপন্থী কর্মধারাকে চিহ্নিত করেন। তাঁর এসব সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজনীতি সঠিক নির্দেশনা লাভ করে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা সঞ্চারিত হয় এবং দেশেও আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসে। তিনি ছিলেন সুদক্ষ সুশাসক। বিশৃঙ্খলা, অবাধ্যতা এবং অনানুগত্যকে অতিক্রম করে তিনি সমাজে ‘আইনের শাসন’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি নিজেকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ÒThe benevolent modernizing leader (হাবিব জাফরুল্লাহ : প্রাগুক্ত) বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্রতী হন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারী উন্নয়নে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
শিশু-কিশোর, যুবক সকল শ্রেণির সাংস্কৃতিক ও শারীরিক উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অতীতের শাসকদল সৃষ্ট বিভেদের পরিচয় পরিত্যাগ করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবর্ণ গ্রহণপূর্বক বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক সীমারেখার ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ।
সাংবিধানিক সংস্কার
শহীদ জিয়ার সাংবিধানিক সংস্কারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, আদর্শিক বা নীতিগত পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত পরিবর্তন। এভাবে তিনি পূর্বের সরকার কর্তৃক গৃহীত অযাচিত সাংবিধানিক মৌলিক নীতির গণমুখী পরিবর্তন সাধন করেন এবং বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করেন। এভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় নতুন দিকদর্শন সৃষ্টি হয়। নভেম্বর, ’৭৫ থেকে ১৯৭৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সাংবিধানিক পরিবর্তন গৃহীত হয়।
সাংবিধানিক নীতিগত পরিবর্তনসমূহ : ক. সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম সংযোজন। খ. ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপন গ. সমাজতন্ত্রের সাথে সংযোজিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার। ঘ. বাঙালি জাতীয় পরিচয়ের স্থলে ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তা গৃহীত হয়। ঙ. মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সূচিত হয়। এসব আদর্শ ও নীতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জিয়া ১. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন লাভ করেন। ২. মুসলিম বিশ্বের স্বাভাবিক সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। ৩. সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারিত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশসমূহের সমর্থন ও সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়।
সাংবিধানিক কাঠামোগত পরিবর্তন : বাকশাল ব্যবস্থার বিলোপ সাধনপূর্বক বহুদলীয় পদ্ধতি প্রবর্তন ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বাকশালগোষ্ঠী ব্যতীত সকল মত ও পথের জনসাধারণ প্রকাশ্যে এ পরিবর্তনের জন্য জিয়াকে অভিনন্দিত করে। জিয়ার আর একটি কাঠামোগত পরিবর্তন হলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ব্যবস্থা। ঘোষিত পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন বা (পিপিআর)-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলসমূহ কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে বাধ্য হয়। তবে সংসদীয় পদ্ধতির চেয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য অধিকতর উপযোগী বিবেচিত হওয়ায় জিয়াউর রহমান তা অব্যাহত রাখেন। আজকের বাস্তবতায় জিয়াউর রহমান অধিকতর বাস্তববাদী ছিলেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকতা মনে করেন।
শাসনব্যবস্থায় সংস্কার
বাংলাদেশ সমাজের সামাজিক সংস্কার উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নের উপযোগী একটি শাসনব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য জিয়াউর রহমান প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কার্যক্রম উভয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করেন।
তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলী এবং পরবর্তীকালে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনে বিষয়-বিশেষজ্ঞদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশাল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সৎ, নিষ্ঠাবান, যোগ্যতর লোকদের সমাহার দেখে অনেকে একে ‘টেকনোক্র্যাট টাইপ’ শাসনব্যবস্থা বলতে চান। আজকের পৃথিবীতে জেনারেলিস্ট বনাম টেকনোক্র্যাটদের যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায়, তাতে উন্নত বিশ্বে টেকনোক্র্যাটরাই টিকে আছেন।
জিয়াউর রহমান আমলাতন্ত্রকে পুনর্গঠন করেন। আমলা ও রাজনীতিকদের মধ্যে সমতার বিভাজন ও সমন্বয় করেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক কাঠামো, প্রক্রিয়া এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কতিপয় পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। এ ছাড়া ক্ষমতা ও কার্যাবলির বিকেন্দ্রীকরণ, সহজীকরণ, সমন্বয়করণ এবং ব্যয় হ্রাসের ওপর নজর দেওয়া হয়। এ সংস্কারসাধনের উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক প্রতিক্রিয়াশীলতা ও রক্ষণশীলতার মধ্যে লালিত আমলাতন্ত্রকে একটি স্বাধীন জাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় উপযোগী করে গড়ে তোলা। উদাহরণ স্বরূপ, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৯ থেকে ২৪ করা হয়। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে, করপোরেশনগুলোর সদর দফতর স্ব স্ব প্রধান কর্মক্ষেত্র স্থানান্তর, তাদের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যান্স ও পুনর্নামকরণ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি। রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া যেমন সংস্কারসাধন সম্ভব নয়, অপরদিকে আমলাতন্ত্রের সহযোগিতা ছাড়া এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সে জন্য তিনি উভয়ের মধ্যে যথার্থ ভারসাম্যের ব্যবস্থা করেন।
পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন
বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। এ কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সমগ্র প্রশাসনিক জনশক্তির পুনর্মূল্যায়ন, পরিমাপ ও পর্যালোচনা।
এই কমিশন সংগঠন, জনশক্তি, প্রশিক্ষণ কাজের শর্ত ও পরিবেশ, হ্রাসবৃদ্ধি এবং বেতনক্রম নিয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করে। লোকপ্রশাসন ব্যবস্থা এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে নানা ধরনের পরিবর্তন পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মধ্যদিয়ে সুদৃঢ় ভিত্তি ও প্রফেশনালিজম অর্জন করে। জাতীয় সচিবালয় নতুন নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হয়। এসব সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এই স্বল্প পরিসরে প্রশাসনিক সংস্কারের দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় তিনি জাতিকে একটি দক্ষ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ এবং জাতীয় মূল্যবোধসম্পন্ন প্রশাসনিক কাঠামো উপহার দিতে সক্ষম হন। এ সফলতার কারণ ছিল তৎকালে বিরাজিত অনুকূল অবস্থা এবং জিয়ার সুদৃঢ় নেতৃত্ব। তাই বিশ্লেষকরা মন্তব্য zia government in Bangladesh was one instance of a military regime in the third world actively engaged in bureaucratic reforms to attain its desired goals in national development. (হাবিব জাফরুল্লাহ: ১৯৯৬:৯৯)
বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ
বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সংসদে পঞ্চম সংশোধনী আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর আগে জিয়ার রহমান সূচিত সাংবিধানিক সংস্কার ও তাঁর ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানের যে কোনো মৌলিক পরিবর্তন যে গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হতে হয় সে পথ তিনিই দেখিয়ে গেছেন। সুতরাং তাঁর সূচিত যে কোনো বিধান ও নীতিকে পরিবর্তন করতে হলে আরেকটি গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যা হোক, গ্রহণযোগ্যতার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন।
সরাসরি সর্বসাধারণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এই উপমহাদেশে এটাই প্রথম। এর আগে এ অঞ্চলের কোনো দেশেই প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ব্যতিক্রম। এই সরাসরি অর্জিত আস্থার কারণে জিয়াউর রহমান বৈধভাবেই তাঁর কর্তৃত্ব প্রয়োগের সুযোগ পান। সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সৃষ্ট জাতীয় ফ্রন্টের প্রার্থী হন তিনি। অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করে। জিয়াউর রহমান ৭৩. ৬৩% এবং ওসমানী ২১.৭০ শতাংশ ভোট লাভ করেন। নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবার জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে সংসদীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ঘোষিত জোট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিরোধী দল গোষ্ঠীর অনেক নেতা নির্বাচিত হন। যেদিক দিয়ে এই সংসদ অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবি করতে পারে। এত কথা বলার অর্থ এই যে জিয়াউর রহমান ওই সব নির্বাচন ও বিধিব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি আইনানুগতা, বৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন যা সমসাময়িক বিশ্বে একজন সামরিক ব্যক্তিত্বের জন্য বিরল।
স্থানীয় সরকার সংস্কার
জিয়াউর রহমান স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ইউনিয়ন কাউন্সিলের গঠন পদ্ধতি সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
এই অধ্যাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আরো প্রান্তিক পর্যায় অর্থাৎ গ্রামকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রথম ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার বিধান রাখা হয়। এর নাম দেওয়া হয় গ্রাম পরিষদ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদ ‘গ্রাম সরকার’ বিল আইনে পরিণত করে। এর আগের ইউনিয়ন পরিষদ বিলোপ না করে গ্রাম সরকারকে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় শাসনব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে গ্রাম সরকার ব্যবস্থাই প্রান্তিক পর্যায় গঠিত তৃণমূল সংগঠন।
এদিকে মৃত জেলা পরিষদকে গণপ্রতিনিধিত্বশীল করার প্রয়াস পান জিয়াউর রহমান। ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে ২০টি জেলায় ২০ জন এসপিকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী বা ডিডিসি হিসেবে নিয়োগ দেন। ডিডিসি জেলার উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবেন এবং স্থানীয় অভিযোগগুলোর মীমাংসা করবেন বলে ঘোষিত বিধিবিধানে বলা হয়। স্থানীয় সরকার সংস্কারের বছরখানেক পরে জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর সব প্রয়াস পরিত্যক্ত হয়।
গণমুখী কর্মসূচি
ক. স্বনির্ভর কর্মসূচি : মাহবুব আলম চাষীর নেতৃত্বে একটি স্বনির্ভর আন্দোলন কাজ করছিল গ্রামভিত্তিক স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান রাজি হন স্বনির্ভর কর্মসূচির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণে। সেই থেকে নানা পর্যায় অতিক্রম করে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার আন্দোলন সরকারি অনুমোদন বা আনুকূল্য লাভ করে। একটি গ্রামের স্বনির্ভরতা অবশেষে সারা দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দেবে এ ধারণা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য জিয়াউর রহমান উৎপাদন দ্বিগুণ করার আহ্বান জানান।
খ. খাল খনন কর্মসূচি : খাদ্য উৎপাদন এবং নাব্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য জিয়াউর রহমান সারা দেশে হাজামজা অর্ধমৃত সব নদী পুনঃখননের আহ্বান জানান। তিনি যশোরের ‘উলসী’ প্রকল্প দিয়ে এ কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীকালে খনন কর্মসূচিকে সমধিক গুরুত্ব দেন। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে পলি জমে যাওয়া খাল, নদী খননের ধুম পড়ে যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকেন এবং নিজ হাতে কোদাল ধরেন।
খননকাজের ফলাফল হিসেবে পরবর্তী মৌসুমে ধানের উৎপাদন ছয় লাখ টন বেড়েছে বলে কৃষি পরিসংখ্যানে বলা হয়।
গ. গণশিক্ষা কর্মসূচি : খাল খনন কর্মসূচি অবশেষে জিয়া গণশিক্ষা কর্মসূচিকে তাঁর সূচিত বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ বলে বর্ণনা করেন। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবসে গণশিক্ষা কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। ২৪% শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পরবর্তী পাঁচ বছরে ৮০% শিক্ষিত করার পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। সর্বত্র বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হয়। গণমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গণশিক্ষায় অবদান রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।
ঘ. জন্মনিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ অনুন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে দায়ী করা হয়। জিয়াউর রহমান একে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ‘দুটো সন্তানই যথেষ্ট’, বাল্যবিবাহ নিরোধ, ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। একটি মুসলিম রক্ষণশীল সমাজে তাঁর এ ধরনের প্রচারণা জনপ্রিয়তার জন্য বিপজ্জনক বিবেচিত হতে পারে জেনেও তিনি দেশের স্বার্থে জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাকে সর্বতোভাবে সফল করার চেষ্টা করেন।
ঙ. যুব উন্নয়ন কমপ্লেক্স : যুবসমাজের জন্য উন্নয়ন এবং তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন জিয়াউর রহমান। তাদের মধ্যে দেশ গড়ার নতুন শপথ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয় নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেন। যুবকদের প্রশিক্ষণ, ঋণসুবিধা প্রদান এবং গ্রামগঞ্জে, হাটবাজার ইজারা অথবা খালবিলে মৎস্য চাষের মতো কর্মসূচি দ্বারা তাদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াসী হন তিনি। তাঁর কর্মসূচির দ্বিতীয় অংশ ব্যর্থ হলেও যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয় আজ যুবগোষ্ঠীর উন্নয়নের প্রধান বাহনে পরিণত হয়েছে।
চ. গ্রাম প্রতিরক্ষা দল : গ্রামের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য জিয়াউর রহমান গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি গঠন করেন। এটা ছিল প্রচলিত চৌকিদার বা আনসারব্যবস্থার অতিরিক্ত। প্রতিটি গ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়নকাজে অংশগ্রহণ এবং গঠিত গ্রাম সরকারকে সহায়তা দান তাদের কর্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়। জিয়া যে সেনাসুলভ শৃঙ্খলা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ভিডিপি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জিয়ার অন্য সব গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে এটি অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা এবং স্থায়িত্ব লাভ করে।
ছ. সিটিজেন আর্মি বা নাগরিক সেনাবাহিনী : বাংলাদেশ প্রতিরক্ষায় অপ্রতুল সেনাসংখ্যার কথা বলতেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশে তৎকালে কর্মরত মার্কিন সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্ডার সঙ্গে একান্ত এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমান ইসরাইল অথবা সুইজারল্যান্ড স্টাইলে ‘সিটিজেন আর্মি বা নাগরিক সেনাবাহিনী গড়ার কথা বলেছিলেন। এ ধারণা মোতাবেক প্রতিটি সুস্থ সবল নাগরিক সেনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে এবং যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে সেনাছাউনিতে হাজির হবে।
উপসংহার
জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত শাসন আমলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় মৌলিক এবং স্থিতিশীল পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিটার বেট্রেসি জিয়াউর রহমানের শাসনকাল সম্পর্কে মন্তব্য করেন:
“ It (zia regime) played safe in politics and economics, and in doing this, it became the victim of distributive politics a praetorian political system”
তাঁর অনুসৃত রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম জাতিকে নীতি বা কৌশলগত শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রদান করে। সমাজবিজ্ঞানী হান্টিংটন এবং ভনদার মেহদান এ অবস্থায় আশা করেন :“The most promising path toward social, political and economic development” (হান্টিংটন: ১৯৬৮:২২৮, ভনদার মেহদান : ১৯৬৯: ৯২-১০০) জিয়াউর রহমানের অবদান তাঁদের হতাশ করেনি। সমাজ ও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তিনি সামাজিক অগ্রগতি, রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছেন। কার্যকর শাসনব্যবস্থার জন্য যে কলাকৌশল, ঐকমত্য, আপসকামিতা প্রয়োজন, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রথা প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। ‘জিয়ার শাসনকাল বিক্ষুব্ধ ঘটনাবলি সত্ত্বেও বাংলাদেশিদের রাষ্ট্রকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছে, স্বাধীনতার সময়কালেও যা অর্জিত হয়নি।‘ (আলী, ১৯৯৬:১৬২)