মেহেরুন্নেসার প্রস্থান

সেলিম স্যারের কাছেই চলে গেলেন তিনি

Looks like you've blocked notifications!

এই বিশ্বচরাচরের মহৎপ্রাণের যিনি মহান স্রষ্টা, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুদূত প্রাণকে মিলিয়ে দেয় তারই প্রিয় প্রাণের কাছে। জীবন আর মৃত্যুর এ এক বিস্ময়কর লীলা। আমাদের কালের বহুমাত্রিক শিল্পকর্মী, বাংলা নাটকের শেকড়সন্ধানী যুগস্রষ্টা সেলিম আল দীনের শিল্পসঙ্গী ও প্রিয়পত্নী পৃথিবী নামের এই গ্রহটিতে তাঁর শেষ যাত্রাপথ পাড়ি দিলেন আজ। আর পৌঁছে গেলেন এমন এক নব উদ্যানে যেখানে থাকেন তাঁরই প্রিয় শিল্পসখা।

আমার পিতৃপ্রতিম শিক্ষক অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী আমাদের শিল্পমাতা বেগমজাদী মেহেরুন্নেসাও স্যারের মতো আজ অন্তিমশয়ান গ্রহণ করলেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি স্যার চলে যাওয়ার পর সেলিম আল দীন সম্পর্কিত আমাদের সকল ঔৎসুক্যের আবদার মেটাতেন এই জননী। জীবন ও মৃত্যু এক বিস্ময়কর মেলবন্ধন রচনার কারিগর! ১৪ জানুয়ারি স্যার গেলেন; প্রায় একই সময়ে মাত্র চারদিন আগে এক হিম সকালে জাহাঙ্গীরনগরের পাখপাখালির নিসর্গ ছেড়ে হাসপাতালের বিছানাকে স্যারের মতোই শেষনিশ্বাসের অন্তিম ঘর বানালেন। প্রিয় মাতা, এবার স্যারের হাত ধরে হেঁটে চলবেন অন্য এক অনির্বচনীয় অতুল্য স্বর্গ-নিসর্গে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নাটক রচনা ও নাট্যভাবনায় বাংলা ভাষার প্রবাদপ্রতিম নাট্যস্রষ্টা সেলিম আল দীন তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিকর্ম দিয়ে আমাদের ঋদ্ধ করেছেন। গ্রামীণ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, আদিবাসীদের বহুচর্চিত কৃত্য, অরণ্যের বিলিয়মান কোনো অচিন জাতি কিংবা বাঙালির হাজার বছরে রীতি বা ঐতিহ্যই ছিল তাঁর শিল্পভাবনার নান্দনিক পট। সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ নিসর্গে বসে সেই পটে এঁকেছিলেন বাংলা গান, কবিতা বা গল্পের অদ্বৈত এক ছবি। আর এই ধ্যানমগ্ন শিল্পপুরুষের ছায়াসঙ্গী ছিলেন তাঁরই প্রিয়পত্নী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা। সেলিম স্যার যাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘পারুল’ নামে। 

ফেনীর সোনাগাজীতে জন্মগ্রহণ করা নাট্যকার সেলিম আল দীন ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করটিয়ার সা’দত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সেলিম আল দীনের করটিয়া সা’দত কলেজে পড়াকালীন ওই কলেজের সে সময়ের অধ্যক্ষ মানিকগঞ্জের মোকসেদ আলী খানের বড় মেয়ে মেহেরুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। দুজনেই ওই কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৪ সালে সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকালমৃত্যু হওয়ার পর নিঃসন্তান ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেলিম আল দীনের শিল্পশিষ্যরাই তাঁদের সন্তানবৎ ছিলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফকে সঙ্গী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মেহেরুন্নেসা ছিলেন সেলিম আল দীনের সমগ্র কর্মপ্রয়াসের প্রাণান্ত অনুপ্রেরণা।

সেলিম আল দীনের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জে ছিল বলেই ওই এলাকার শিল্পসৌন্দর্যে তিনি যারপরনাই মুগ্ধ হতেন। মানিকগঞ্জের বহু কেচ্ছা-উপকথা-গল্প সেলিম আল দীনের রচনাকর্মে স্থান পেয়েছে। তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘হরগজ’-এ মানিকগঞ্জ অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ঐশ্বরিক দুর্যোগে বিপাকে পড়া মানুষের জীবনকাহিনী বিবৃত হয়েছে। আর এভাবেই কালক্রমে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা হয়ে উঠেছিলেন সেলিম আল দীনের যথার্থ শিল্পজায়া।  

ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটারের জ্যেষ্ঠ সদস্য মেহেরুন্নেসা নাটকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেলিম আল দীন পরবর্তী সময়ে এই বরেণ্য নাট্যকারকে কেন্দ্র করে সকল স্মরণসভা বা নাট্যোৎসবে মেহেরুন্নেসার সরব উপস্থিতিই ছিল না শুধু; অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে প্রয়োজনীয় সব শলাপরামর্শও দিতেন তিনি।

শিল্পবোদ্ধা, বৃক্ষপ্রেমী এবং ব্যক্তিগত জীবনে সদা হাস্যোজ্জ্বল ও সদালাপি বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা আমাদের মতো সেলিম স্যারের শিল্পশিষ্যদের সকল উৎপাত নীরবে সহ্য করতেন না শুধু নিজ হাতে সবাইকে খাইয়ে তৃপ্ত হতেন। তাঁর অপার ভালোবাসার অজস্র ঋণ আজীবন বইয়ে বেড়াব আমরা সবাই।   

১৮ আগস্ট ২০০৭ সালে সেলিম স্যারের শেষ জন্মদিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের থিয়েটার ল্যাবে আয়োজিত জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্যার আসলেন। শিক্ষার্থীরাও আছে। সেলিম স্যার নিজেই আয়োজন করেছেন সব। স্যার নিজ হাতে অনেককেই মিষ্টি-লুচি খাওয়ালেন। আমাকে বললেন,

তোর ম্যাডাম তো মিষ্টি খেতে পারবে না, সবজি আর লুচি পাঠিয়ে দিস!

আমাদের এই শিল্পমাতা লুচি-সবজিতেই কত যে খুশি ছিলেন!

নানা ব্যস্ততায় হয়তো বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক আমাদের এই জননীর যথার্থ যত্ন-আত্তি করবার মতো সময় সেলিম স্যার বের করে উঠতে পারতেন না। তবে স্যার খুব ভালোবাসতেন তাঁর পারুলকে।

সেলিম স্যারের সব পাণ্ডুলিপি যত্ন করে রাখতেন এই পারুল। স্যারকে নিয়ে লেখা পত্রিকার কাটিংগুলো সযত্নে রক্ষা করতেন তিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেলিম স্যারের সব পুস্তকে গ্রন্থস্বত্ব’র জায়গাটিতে বেগমজাদী মেহেরুন্নেসারই নাম উৎকীর্ণ করা।

সেলিম আল দীন তাঁর রচনাসমগ্রের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় নিজেই লিখেছেন, এই সংগ্রহের কোনো রচনাই সংকলিত হওয়ার উপায় ছিল না। যদি না পারুল আমার সব পাণ্ডুলিপি একটা আলাদা সংসারের মমতায় সংরক্ষণ করত।

আমার শিক্ষক ও কবি খালেদ হোসাইন যথার্থ বলেছেন, সেলিম আল দীনের অনেক কিছু ছিল, কিন্তু বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার কিছুই ছিল না সেলিম আল দীন ছাড়া, তাই তিনি চলে গেলেন সেলিম-স্যারের কাছে, জানুয়ারিতেই! আর আমাদের শিল্পগুরু ও পিতৃপুরুষ সেলিম আল দীন তাঁর রচিত একটি স্তোত্র সাজিয়েছিলেন এভাবে-

 

কত নক্ষত্রের তরঙ্গ

ভেদ করে যায় তোমাকে

অদৃশ্যরশ্মি তার।

এইভাবে মানুষ

নিজের অজান্তে

মহাজাগতিক হয়ে উঠে।

হে মহাজাগতিক শিল্পমাতা! অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি তোমায়!
 

লেখক : সেলিম আল দীনের ছাত্র ও সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন