পাঠকের কলাম

অন্যরকম তিন নায়ক

Looks like you've blocked notifications!

সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে বাস্তব চরিত্রের মিল খুব কমই দেখা যায়। তবে মাঝে মাঝে জগৎসংসারে রিয়েল হিরোর দেখা মেলেও বটে! কিছু মানুষ থাকে যাদের আত্মত্যাগ আর নায়কোচিত কর্মকাণ্ড সত্যিই নাড়া দেয়। স্বার্থপরতার চরম দ্বন্দ্বে জগৎসংসারে যখন মানুষ স্বাভাবিক মানবিকতা ভুলে রয়েছে তখন অপরের জন্য নিজের জীবন বিসর্জনের কাহিনী নির্ঘাত অতিসাধারণ কিছু নয়! অসম্ভব রকম উন্নত মানসিকতা আর মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারলেই কেবল সেটা সম্ভব। অন্যের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করার এ অসাধারণ মানসিকতা মানবিকতার অনন্য উদাহরণ বৈ অন্য কিছু হতে পারে না। 

বাদলের আত্মত্যাগ

ঘড়ির কাঁটায় তখন বাজে বেলা ১টার কিছুটা কমবেশ। ছোট্ট শিশুকে সঙ্গে নিয়ে তখনো তার মা রেললাইন পার হতে পারেননি। রেললাইনের পাশ থেকে এক ব্যক্তি ওই মাকে টান দিয়ে সরিয়ে নিলেন। রেললাইনের ওপারে রয়ে গেল শিশুটি। এটা দেখে ছুটে গেলেন রেললাইনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রেল কর্মচারী বাদল মিয়া। শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু বাদল আর সরার সময় পেলেন না। ট্রেনের নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাদলের শরীর। মুহূর্তেই নিভে গেল তাঁর জীবনবাতি। রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের রেলগেটের এ ঘটনাটি হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বাদল রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত একদল কর্মচারীর সঙ্গে সেখানে কাজ করছিলেন। কাজে আসার পর যে আর ঘরে ফেরা হবে না তা কে জানত! ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মুখি গ্রামের সন্তান বাদল। আট সন্তানের জনক। কাওলা রেলগেট এলাকায় রেলওয়ের জমিতে টিনের ঘর তুলে সেখানে পরিবার নিয়ে থাকতেন। অতিসাধারণ জীবন-যাপনের অধিকারী বাদল আজ সমাজের চোখে ‘নায়ক’।

ওদিন বাদলসহ আরো ৮-১০ জন কাজ করছিল। এগিয়ে আসল বাদল। ট্রেনটি যখন আসছিল, তখন তাঁরা সার বেঁধে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাচ্চাটি যখন রেললাইনের ওপর রয়ে গেল, তখন ১০-১২ ফুট দূর থেকে বাদল দৌড় দেন। ধাক্কা দিয়ে বাচ্চাটিকে রেললাইন পার করে দেন। কিন্তু এরপর তিনি আর সময় পাননি। প্রায় ২৯ বছর ধরে রেলওয়েতে কর্মরত বাদলের জীবনবাতি নিভতে ২৯ সেকেন্ড সময় নিল না সেই রেল। ৮-১০ বছর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চাকরি করার পর তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। তাঁর আয় দিয়েই পুরো পরিবার চলত। মাত্র তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাদল। বড় ছেলে বিয়ে করলেও বেকার। আরেক ছেলে কয়েক দিন হলো খিলক্ষেত রেলগেটে অস্থায়ী গেটম্যানের কাজ শুরু করেছেন। বাকিরা পড়াশোনা করছে। বাদলের মৃত্যু পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে দিল। সিলেট থেকে ঢাকাগামী সুরমা এক্সপ্রেসের নিচে কাটা পড়েছে বাদলের জীবন। তবে বেঁচে গেল অন্য একটা জীবন! হয়তো এটাই বাদলের সার্থকতা। এটাই তাঁর জীবনের প্রাপ্তি।

খাদিজার রক্তে রক্তাক্ত ইমরান

ধারালো চাপাতির একের পর এক আঘাত। রক্তাক্ত খাদিজা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন নিথর। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না। দূর থেকে হৈচৈ শুনে এগিয়ে এলেন একজন। তারপর ভূলুণ্ঠিত মানবতাকে তুলে নিলেন কোলে। রক্তাক্ত খাদিজাকে কোলে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। তিনি হচ্ছেন ইমরান। পুরো নাম ইমরান কবির। খাদিজা আক্তার নার্গিস এখন বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন কি না, সেটা নিয়ে জোর সংশয় ছিল তখন। তবে খাদিজার উদ্ধারের পেছনে রয়েছে ইমরান কবিরের ভূমিকা। রক্তাক্ত নিথর খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ফলে তিনি চিকিৎসাসেবা পান।

টগবগে তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক ইমরান কবির (২০)। সিলেট সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের এই যুবক। প্রকৃতির সুনিবিড় ছায়াঘেরা এমসি কলেজে হাঁটতে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর তো অসীম সাহসিকতায় মানবতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

বদরুল আলম নামের নিকৃষ্ট অমানুষের চাপাতির আঘাতে এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে লুটিয়ে পড়েন খাদিজা আক্তার নার্গিস। রক্তাক্ত খাদিজা নিথর হয়ে পড়ে থাকলেও কেউ এগোয়নি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। যখন ওই ঘটনা ঘটে, তখন কিছুটা দূরে ছিলেন ইমরান কবির। শোরগোল শুনে ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে থাকেন তিনি। তারপরেরটা ইতিহাস। ইমরান কবির ছিলেন আলোচিত এ ঘটনার আসল ‘নায়ক’। তাঁকে নিয়েও শোরগোল কম হয়নি। ইমরান কবিরও মিডিয়ার আলোচনায় ছিলেন বেশ কিছু দিন।

শের আলীর বীরত্ব

চট্টগ্রামে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত শের আলী তিনদিনের ছুটি নিয়ে দুপুরের খানিক আগে বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের পানিরছড়া এলাকায় বাস উল্টে যাওয়ার দুর্ঘটনার খবর শোনেন। দুর্ঘটনাস্থল থেকে বাড়ি খুব কাছে হওয়ায় তিনি কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিয়ে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর প্রায় তিন ঘণ্টা পর বাসের ভেতরে ব্যাগ রাখার জায়গায় এক শিশুকে আটকে থাকতে দেখেন তিনি। ব্যাগ রাখার স্থানে শিশুটির মাথা থেকে চোখ পর্যস্ত আটকে ছিল তখন। সেটি ফাঁক করে মেয়েটিকে উদ্ধার করার পর শের আলী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াতে থাকেন হাসপাতালের উদ্দেশে। যে কান্নার দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় মানবিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ঝড় তোলে। সারা দেশে পুলিশের প্রতি মানুষের যে নেতিবাচক মনোভাব, সেই মনোভাব পাল্টাতে আরো অনেক শের আলী আমাদের প্রয়োজন। কিছু বাস্তবিক ঘটনা মাঝেমধ্যে রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। আর যে মানুষটি রূপকথার ঘটনা বাস্তবে জন্ম দেন, তাঁকে তো রিয়েল হিরো না বলে উপায় থাকে না। অন্যরকম মানবিক এ গল্পের হিরো শের আলী। যিনি নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন পুরো দেশ।

‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমীয় বাণী। তিনি লিখেছেন কবিতায় আর তা মিলেছে আমাদের জীবনের সঙ্গে। সিনেমার নায়কদের মতো বাস্তবের নায়কের সঙ্গে সচরাচর দেখা না মিললেও মাঝে মাঝে সত্যিই নিঃশেষে কিছু মানুষ প্রাণ দান করে যাওয়ার পণ করে। মানবিকতার যে উন্মেষে জীবনের জন্য জীবনের এই ভালোবাসা জেগে উঠুক সমাজের প্রতিটি স্তরে।

লেখক : এনটিভি অনলাইন প্রতিনিধি, শাবিপ্রবি (সিলেট)।