নরেন্দ্র মোদির আগমন : সুখবরের অপেক্ষায় বাংলাদেশ
৩৬ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি। স্বাগত নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় সংসদে স্থল সীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংশোধনী পাস হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে মোদি জানিয়েছিলেন ‘আমি ভালো খবর নিয়েই আসছি’।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, তিনি বিপুল উৎসাহ ও আনন্দের সাথেই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। একই সঙ্গে তাঁর এই সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্ক আরো মজবুত হবে বলেই তিনি মনে করছেন। গত কয়েকদিনে মোদির সফর থেকে আমরা কী কী ভালো খবর পেতে পারি এই বিষয়ে বাংলাদেশের ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে।
প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও নিয়মিত চলছে মোদির বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত প্রাত্যহিক খবরের নানা তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানাবিদ দিক আলোচনা করলে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, মোদির বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। যাকে এক কথায় বলা চলে অকৃত্রিম। অকৃত্রিম বন্ধুর কাছে কৃত্রিমতা বিবর্জিতভাবে নানা সমস্যার সমাধান চাওয়া কিংবা সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করে শান্তিপূর্ন সমাধানে চুক্তি স্বাক্ষর করা অবশ্যই যৌক্তিক। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ভারত অকৃত্রিমভাবেই এগিয়ে এসেছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক অধ্যায়ের সৃষ্টি হবে এমনটিই প্রত্যাশা বাংলাদেশের জনগণের। কেননা বাংলাদেশ-ভারত সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় বিবেচনায় আনলে দেখা যায় বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি দীর্ঘ ৪১ বছর পর বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীদের সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন আর ছিটের বাসিন্দা হিসেবে নয়, তাঁরা পরিচিত হবেন নিজ নিজ দেশের পরিচয়ে। আর এই অর্জন এসেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময়ে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির ফলে আরো অনেক সমস্যারই সমাধান হয়েছে। সঙ্গত কারণেই মোদির এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে।
তিস্তা- বাংলাদেশে ব্যাপক আবেগতাড়িত একটি বিষয়। মোদির সফরে তিস্তা সম্পর্কিত জটিলতারও একটি সহজ সমাধান প্রত্যাশিত। এ ছাড়া এই সফরের মাধ্যমে বহুল আলোচিত সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সংক্রান্ত আলোচনা, পাটের ব্যাগ রপ্তানি সংক্রান্ত আলোচনা, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা সংক্রান্ত আলোচনা, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি বাড়ানো সংক্রান্ত আলোচনা ও চুক্তি বণ্টন, ভারতের পণ্য আমদানি সংক্রান্ত আলোচনা, দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দুই দেশের স্থল বন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন সংক্রান্ত আলোচনা, রামগড় ও তেগামুখ স্থল বন্দর কার্যকর করতে ফেনী নদীতে ব্রিজ সংক্রান্ত আলোচনা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, দুই দেশের মধ্যে ঋণ সুবিধা, বাণিজ্য, নৌ চলাচল, বিদ্যুৎ, শিক্ষা বণ্টন, বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য ই-ট্যুরিস্ট ভিসা (ইটিভি) চালু, চোরাচালান, শিশু ও নারী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণ, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশিদের আসন সংরক্ষণসহ আরো বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়ে মীমাংসার দ্বার উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে এবং ভারতের নির্বাচনের আগে দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নেতিবাচক কথা প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু দুই দেশের বর্তমান চলমান সম্পর্কের নানাবিধ দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব নেতিবাচক কথা ছিল শুধুই বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা।
নরেন্দ্র মোদি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার ডক্টর শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর কিছু দিন পরই বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। মোদির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয় ভারত সফরের আমন্ত্রণ। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয় ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর।
বড় অর্থনীতির দেশ ভারত। দুই দেশের সম্পর্ক যত জোরদার হবে ততই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত অবদান রাখতে পারবে। সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্টতই বলা যায়, মোদির সফরের মাধ্যমে অর্থনীতি, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন ও কানেকটিভিটির আলোকে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। দুই দেশের মধ্যে ভিসা ব্যবস্থা ও রেল ব্যবস্থার আরো উন্নয়নের জন্য কাজ হবে।
বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আমরা আশা করতে পারি, মোদির ৩৬ ঘণ্টার এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে- ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে বাংলাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন নরেন্দ্র মোদি। আর এ জন্য মোদিকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে।
লেখক : অনুবাদক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।