মোদি হাওয়া, আমাদের চাওয়া পাওয়া

Looks like you've blocked notifications!
ড. আবদুল লতিফ মাসুম

নরেন্দ্র মোদি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে একধরনের শঙ্কার সৃষ্টি হয়। এমনিতেই ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’সুলভ কর্মকাণ্ডের ইতিহাস রয়েছে, তাঁর ওপর নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিচিতি এবং গুজরাটের বদনাম তাঁকে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে নেতিবাচকভাবেই উপস্থাপন করে। প্রতিবেশীরা মনে করতে থাকে যে তারা মোদির উগ্র দেশপ্রেম বা সম্প্রসারণবাদ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।

তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত রাষ্ট্রনায়কদের আমন্ত্রণও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নেতাদের উপস্থিতি কি তাঁর সৌকর্য প্রদর্শনের জন্য, নাকি সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য- সে প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই শঙ্কার স্থলে আশার সৃষ্টি হয়। নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিন্যাসে নতুন নীতি গ্রহণ করে। প্রথমেই তিনি ছোট্ট দেশ ভুটান সফর করেন। তারপর ক্রমান্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং অবশেষে বাংলাদেশে এলেন।

তাই বাংলাদেশেও তাঁর সফর নিয়ে আশঙ্কার চেয়ে আশাবাদ একটু বেশি। ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতন-একটি রাজনৈতিক ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। অবশ্য এতে সরকারবিরোধী বিএনপি মহলে আশার সঞ্চার হয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরাক্রমশালী প্রতিবেশীর হাত রয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত এ ক্ষেত্রে মোদি সরকারের অনুরাগ বা বিরাগ কোনোটিই লক্ষ করা যায়নি। ভারতের রাষ্ট্রনীতির যে স্থায়িত্ব আছে এবং কোনো অনুরোধ-উপরোধ যে নীতির পরিবর্তন করে না, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এসে দুটি বিষয় নিশ্চিত করেন, আর তা হলো ভারত সরকার বাংলাদেশের কোনো দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক চায় না বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বিন্যাসে বিশ্বাসী। তিনি আরো নিশ্চিত করেন যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অংশীদারত্বের গণতন্ত্র দেখতে চায়।

মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস সরকার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে সীমান্ত চুক্তি পার্লামেন্টে অনুসমর্থনে ব্যর্থ হয় এবং পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হয় তখন কূটনীতিকরা আশঙ্কা করছিলেন যে ওই চুক্তি আর আলোর মুখ দেখবে না। কারণ মনমোহন সিং যখন তখনকার বিরোধী দল বিজেপিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের অনুরোধ জানান, তখন বিজেপি তা প্রত্যাখ্যান করে। এখন যখন বিজেপি ক্ষমতাসীন, তখন কংগ্রেসকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে এ চুক্তির অনুমোদন নিতে হয়। এটাই বোধহয় রাজনীতি! এবারও প্রবাদটি সত্য হলো। রাজনীতিতে স্থায়ী মিত্র বা স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। আছে স্থায়ী স্বার্থ। কী সেই স্বার্থ? যে কারণে একজন কঠিন নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রতি সহজেই হাত বাড়ালেন? উত্তরটি দুই রকম। একটি ইতিবাচক, আপরটি নেতিবাচক। ইতিবাচকটা হচ্ছে এ রকম, যে নরেন্দ্র মোদি সরকার প্রকৃত পক্ষেই সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চায়।

তারা বিরোধপূর্ণ অতীত ফেলে রেখে নতুনভাবে গড়তে চায় এই উপমহাদেশ। অপর দিকে নেতিবাচক ব্যাখ্যা হচ্ছে এ রকম- মোদি ভারতীয় করপোরেট পুঁজির প্রতিভূ। তিনি বাংলাদেশের বিরাট বাণিজ্য ক্ষেত্র দখল করতে চান। তিনি উদারতা দেখিয়ে আসলে করিডর নিশ্চিত করতে চান। এ ছাড়া ভারত পূবাঞ্চলীয় ‘সপ্তকন্যা’-র নিরাপত্তা চায়। সবারই জানা কথা যে পূবাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। এই গ্রুপগুলো যদি বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করার সুযোগ পায়, তাহলে ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য যে, রাজ্যসভা এবং লোকসভায় যখন সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করা হয়, তখন ভারতীয় নেতারা যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন, তার মধ্যে রয়েছে- ক) বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে সহায়তা, খ) বাংলাদেশি নাগরিকদের অযাচিত সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ, গ) মেঘালয়ের সীমান্তে অসমাপ্ত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ সমাপ্তকরণ। একটি রাষ্ট্র তার জাতীয় নিরাপত্তার রক্ষার্থে এ ধরনের কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে তা সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় স্বার্থ বা জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের। ভারত সরকার শুধু আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিয়ে এগোয়নি বরং বিরোধী পক্ষকেও রাজি করানোর চেষ্টা করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া দুই বছর আগে যখন মনমোহন সরকারের আমন্ত্রণক্রমে ভারত সফর করেন, তখন তিনি ভবিষ্যতে ভারতবিরোধী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার নিশ্চায়তা দেন। নরেন্দ্র মোদির এবারের বাংলাদেশ সফরের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর বিরোধী দল বিএনপির তরফ থেকে ভারতবিরোধী রাজনীতি না করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। মৌলবাদী বলে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীও মোদিকে স্বাগত জানায়। সুতরং এটা স্পষ্ট যে,  স্বেচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায় হোক বাংলাদেশে এ মুহূর্তে অনুকূল মোদি হাওয়া বইছে। 

মোদি হাওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া পাওয়াও অনেক। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিরোধীয় বিষয় অসংখ্য। তার মধ্যে যেগুলো অত্যন্ত সংবেধনশীল তা হচ্ছে ১. পদ্মা তথা গঙ্গা , তিস্তা, ফেনী নদীসহ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যা, ২. সীমান্তে অহরহ বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা, ৩. ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি, ৪. সীমান্তে চোরাকারবার প্রতিরোধ, ৫. সীমান্তের উভয় দিকে সন্ত্রাস প্রতিরোধ ইত্যাদি। পদ্মা তথা গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন ক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বটে, তবে তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। তিস্তা পানিবণ্টনের ব্যাপারে মনমোহন সরকার চুক্তিটি চূড়ান্ত করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তা স্বাক্ষরিত হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ আগে মমতা যখন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন।’ আমরা আস্থা রেখেছিলাম। এখন যখন নরেন্দ্র মোদির এই সফরকালে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারত, তখন মমতা আবারও আশ্বস্ত করলেন। আমরা আর কতকাল এ আশ্বাস বাক্যে তুষ্ট থাকব? আরেকটি মর্মান্তিক সমস্যা হলো সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের বেপরোয়া হত্যা। জনবহুল দুটি দেশের সমস্যা আকীর্ণ সীমান্তে হাজারো সমস্যা থাকতেই পারে! তাই বলে মানুষ হত্যা? বিএসএফের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, নিগ্রহ এবং নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির কাছে আমাদের বিনীত প্রার্থনা আর যেন কোনো ফেলানীকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে না হয়! ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ব্যবধান অনেক। ঐতিহাসিকভাবে যৌথ পরিবারের মতো বেড়ে ওঠা দুই দেশের অপরিহার্য বিনিময়কে বৈধ এবং বাস্তবানুগ করার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। উভয় দেশের সন্ত্রাসী, মানবপাচারকারী, মাদকদ্রব্য এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। শুধু আনুষ্ঠানিক নাগরিক প্রত্যর্পণ চুক্তি নয়, উভয় দিকের সীমান্তের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিরোধে এ সমস্যার সমাধান সহজেই আশা করা যায়। 

আশার কথা এই যে মোদির দুদিনের সফরের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। এসব চুক্তি হচ্ছে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ-প্রটোকল, পণ্যমান নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি চুক্তি এবং ভিসা সহজীকরণ চুক্তি ইত্যাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করিডর বা কানেক্টিভিটি চুক্তিটি আশা করা যায় চূড়ান্ত করা হবে। এর প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে উভয় প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা এবং কলকাতা-শিলং-গুয়াহাটি রুটের বাস চলাচলের উদ্বোধন করেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। আরো একটি নতুন ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা স্থাপনে সম্মতিস্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রিলায়েন্স ও আদানির মতো বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী রয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমণে বাংলাদেশ উচ্ছ্বসিত হয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যখন মোদি অবস্থান করছেন, তখন সর্ববত্রই তিনি এই উচ্ছ্বাসের প্রতিফলন দেখতে পাবেন। দুদিনের সফরের ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত এ সফর দুই দেশের জনগণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের ব্যাপক কল্যাণে সুফল বয়ে আনবে।’ মোদির সঙ্গে আমাদেরও প্রার্থনা, ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক।’

লেখক : অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।