ফিরে দেখা

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা

Looks like you've blocked notifications!

আজ ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস। ছয় দফা দাবি পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি বা ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত। ১৯৬৬ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ নিহত হন ১০ বাঙালি।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান অশুভ শোষণের কালো হাত থেকে মুক্তি পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সুদীর্ঘ ২৪ বছর শাসন করে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের এই পরিকল্পিত শোষণের হিংস্র দাবানল থেকে মুক্তির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে তাঁর ঐতিহাসিক মুক্তির বাণী তথা ছয় দফা দাবি পেশ করেন।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক শাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে থাকে। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একাধিপত্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিরা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আইয়ুবি দশকে এই বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ছিল ১৫ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত, বাকি অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য। এ ছাড়া আরো নানা ক্ষেত্রেই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। ফলে দেখা যায়, যেখানে ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৩৮ টাকা, ১৯৫৯-৬০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬৭ টাকা। অন্যদিকে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ২৮৭ টাকা। ১৯৫৯-৬০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৭৭ টাকায়। এভাবে দেখা যায়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ওঠে। এ ছাড়া সরকারি চাকুরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের চাকুরের হার ছিল ২৩ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে, যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। এ ছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক বৈষম্য। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের এক সারণিতে দেখা যায়, ১৬ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয়ের ৩৭৯৫ দশমিক ৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ২১১৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা ছিল প্রতিরক্ষা ব্যয়, যার শতকরা হার ছিল ৫৬ শতাংশ। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেই ছিল বৈষম্য। ১৯৬৬ সালে লাহোরে নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্সে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিসংবলিত এক কর্মসূচি পেশ করেন, যা ঐতিহাসিক ছয় দফা নামে পরিচিত। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও পশ্চিমাঞ্চলের নেতারা ছয় দফার বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার চালায়। কিন্তু তাতে কোনোভাবেই সার্থক হতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। মূলত ছয় দফা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালিদের ওপর দীর্ঘদিনের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘটিত পদক্ষেপ।

ছয় দফা কর্মসূচিতে বলা হয়, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নপূর্বক পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বায়ত্তশাসন থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার হবে সংসদীয় প্রকৃতির এবং সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে।

দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র-সংক্রান্ত ক্ষমতা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকবে।

পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য অভিন্ন মুদ্রা থাকবে। কিন্তু সংবিধানে এমন সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।

সকল প্রকার কর, খাজনা ধার্য করার ক্ষমতা ও আদায় করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।

দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে। ফেডারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমানভাবে অথবা সংবিধানে নির্ধারিত হারে আদায় হবে। দেশজ উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে দুই অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করা চলবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে।

অঙ্গরাজ্যগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থায় কার্যকরী অংশগ্রহণের জন্য সুযোগ দান এবং আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত বাঙালির পক্ষে যে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগম করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এই আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হলেও তা বাঙালি জাতির রাজনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। ছয় দফা আন্দোলন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে মুক্তির সনদ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তা আরো বেগবান হয়ে ওঠে।

ছয় দফা কর্মসূচি প্রকাশ হওয়ার পর পাকিস্তানি সরকার ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কেউ কেউ এর অপব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলার জনগণ এসব প্রতিক্রিয়াশীল ও অপব্যাখ্যাকারীকে প্রত্যাখ্যান করে। এর পর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেয়। মূলত ছয় দফা আন্দোলন ছিল সমগ্র বাংলার মানুষের বাঁচার দাবি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে সারা দেশে প্রচারিত হয় ছয় দফা। পাকিস্তানি সরকার ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ বানচাল করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। কিন্তু বাংলার ছাত্রসমাজ ও স্বাধীনতাকামী জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা সভায় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচি সমগ্র বাঙালির চেতনার মূলে বিস্ফোরণ ঘটায়। ছয় দফা ছাড়া জাতি হিসেবে টিকে থাকার অন্য কোনো বিকল্পই ছিল না বাঙালিদের। ঐতিহাসিক ছয় দফাভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধীনতা-সংগ্রামে পরিণত হয়। এই দাবির পক্ষে বাঙালি জাতির সর্বাত্মক রায় ঘোষিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর দলকে জনগণ বিজয়ী করলেও সরকার গঠন করতে না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।

বাঙালি জাতির দুঃখ আর স্বপ্নকে ছয় দফা আক্ষরিক ও বাস্তবিক রূপ দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তা অর্জনের মধ্য দিয়ে ছয় দফা সমুন্নত হলো এক ঐতিহাসিক মর্যাদায়। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেমন ম্যাগনাকার্টা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসেও তেমনি ছয় দফা উজ্জ্বল। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার বাণী, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি ছয় দফা কর্মসূচি।

লেখক : অনুবাদক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি-বিশ্লেষক।