সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড

নির্মম স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠছে মেঘ

Looks like you've blocked notifications!

সাগর মানে সাগর সরওয়ার, সাংবাদিক ছিলেন। আমরা সঞ্জীবদার মেলায় (ভোরের কাগজের ফিচার পাতা) যাঁরা যুক্ত ছিলাম, সাগর ছিলেন তাঁদের একজন। আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সংবাদের জলসায় এসে। সেখানে আমাদের টিম লিডার ছিলেন কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান। এখানে সাগর, আমি, কমলেশ রায় (সকালের খবরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক), প্রয়াত মাহবুব মতিন, দিদার চৌধুরী, শিহাব সুমন, হাসনাইন সাজ্জাদী, আলোকচিত্রী শিহাব ও সোহরাব মিলে আমাদের একটা বড় আড্ডা গড়ে ওঠে। মেহেরুন রুনিও সে আড্ডার ছিল।

আমরা এই ঘনিষ্ঠ জীবনের মধ্যে অনেকেই অনেক জায়গায় চলে যাই। গিয়েছিল সাগর-রুনিও। তারপর একদিন সকালে খবর পাই, রাজাবাজারের বাসায় ওরা লাশ হয়েছে। দৌড়ে গিয়েছিলাম। খুঁজছিলাম মেঘকে। ঘাতকরা মেঘকে মারতে পারত। মারেনি কেন, জানি না। বন্ধুর লাশ নিজেকে মৃত করে দেয়। সেদিন বুঝেছিলাম। হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ এখনো জানা যায়নি খুনের কারণ। খুনিই বা কারা? বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছরে খুনের কিনারা হয়নি। ২০১২ সালের এই দিনে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি।

ঘটনার পরদিন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম এ মামলার তদন্তকাজ শুরু করেন। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রিট পিটিশনে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল এ মামলার তদন্তভার র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়।

র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের পর তিন দফায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়ে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মদ এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন।

এদিকে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত আদালতের ১৫৭টি ধার্য তারিখ পার হয়েছে। সর্বশেষ ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন র‌্যাব তা দাখিল করতে পারেনি। আদালত আগামী ২১ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ‘তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, তদন্তের পাঁচ বছর সময়ে র‌্যাব এ মামলার মোট চারটি তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রথমে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, এর পর ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর আদালতে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। দাখিল করা তদন্ত অগ্রগতি-সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধাঁচের তথ্য লেখা রয়েছে।

সর্বশেষ দাখিল করা অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঘটনাস্থল থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সে ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। চুরি করা ল্যাপটপ কখনো ব্যবহার করা হলে তার তথ্য পাওয়া যেতে পারে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘মামলার ভিকটিম (সাগর-রুনি) সংবাদকর্মী হওয়ায় তদন্তকালে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিএনএ পরীক্ষার সব রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এসব ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা আছে। সে অনুযায়ী তদন্ত চলছে। বিভিন্ন গ্রিলকাটা চোরদের তথ্য সংগ্রহ ও তা পর্যালোচনাও করা হচ্ছে। এ ছাড়া খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ ও মোবাইল যদি কখনো চালু করা হয়, তাহলে আমরা তার লোকেশন জানতে পারব এবং খুনিদের ধরতে সক্ষম হব। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে।’

কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আগামী ২১ মার্চ এ মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’ (সূত্র : রাইজিংবিডি) কী থাকবে সে প্রতিবেদনে? কোন চোর, ডাকাত বা ছিনতাইকারী তাদের হত্যা করেছে? এটা কি নিছক হত্যাকাণ্ড? তাহলে এত সময় লাগছে কেন? এই সময়ক্ষেপণ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সাগর-রুনির লাশটা আজও বুকের ভেতর জেঁকে বসে আছে। মেঘের সন্তপ্ত মুখে আমার সন্তানের করুণ আর্তনাদ ভেসে ওঠে, বাবা-মার আদরহীন চারা-বৃক্ষ হয়ে ওঠে।

বিচার হয়নি সাগর-রুনির হত্যার। কী বিচিত্র দেশ! একজন রাষ্ট্রদূতের ভ্যানিটি ব্যাগ খুঁজে বের করতে এদের পারঙ্গমতার শেষ নেই। শুধু সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে পাঁচ বছর ধরে নিষ্ঠুর খেলা দেখছি। পরিবারের সদস্যরা বিচারের আশায় পার করে দিয়েছেন পাঁচ বছর। এখনো তাঁদের প্রতিক্ষার শেষ নেই৷ মেঘ সাগর-রুনির উত্তরাধিকার। সে যে বয়সে কাগজের ফুল হাতে নিয়ে ছুটবে, পড়ে যাবে আবার ছুটবে চিলেকাটা ঘুড়ির মতো, সেই শিশুটির চোখের ভেতর বাবা-মা হত্যার নির্মম স্মৃতি ডুকরে ওঠে।  এ রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকে সারা জীবনের জন্য শুধু বাবা-মার আদরবঞ্চিত করেই ছাড়েনি, বিচারের নামে উপহাস করছে। ওর মধ্যে তখন এই দেশ সম্পর্কে কী ধারণা হবে? ও স্কুল অ্যাসেমব্লিতে গাইবে—এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি! সবার সঙ্গে ওর অন্তর্গত অর্থ বিপরীত দিকে ধাবিত হবে। শুধু এক মেঘ না, উপহাস আর জবাবদিহির অভাবে প্রতিদিন মেঘের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷

লেখক : সাংবাদিক