বিশ্লেষণ

মোদির সফর ছিল নানামাত্রিক

Looks like you've blocked notifications!

প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব নিয়ে সকলেই কথা বলি। তবে তা বজায় রাখি না অনেক ক্ষেত্রে। প্রতিবেশীর সঙ্গে রেষারেষির সম্পর্ক আমাদের যাপিত জীবনে অনেক বেশি চেনা। ১৯৪৭ সালে জন্ম সময় থেকেই ধনে-জনে-প্রতিপত্তিতে ভারত আমাদের, অর্থাৎ পূর্ব বাংলার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু নতুন জন্ম নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের অমীমাংসিত সমস্যার সূত্রে ভারতের সঙ্গে একটি বৈরী সম্পর্ক তৈরি করেছিল। অন্যদিকে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সূত্রে পূর্ব বাংলার অনেক মুসলমান নেতার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল পশ্চিম বাংলার হিন্দু নেতৃত্বের। এ দায় অবশ্য হিন্দু নেতৃত্বকেই নিতে হবে। কারণ, তাঁরা বঙ্গভঙ্গকে একরৈখিকভাবে দেখেছিলেন। পূর্ববঙ্গের মানুষের মন বুঝতে চাননি। বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের উন্নয়নের যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তাকেও আমলে আনতে চায়নি। বঙ্গভঙ্গের স্মৃতি পাকিস্তান রাষ্ট্রে, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির নেতা-সমর্থকদের মধ্যে একটি ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল। এটিকেই নিজ স্বার্থে সময়ে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা উসকে দিতে চেয়েছে। ভারতের রাজনীতিও এ বিষয়টিকে অনেক সময় কূটচালে ব্যবহার করতে চেয়েছে। পানি বণ্টন সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা ইত্যাদি জিইয়ে রেখে পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে এবং পরে বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রাখতে চেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্য চেয়েছে ভারতবিরোধী চেতনা উসকে রাখতে। এর নমুনা ১৯৫৪ সাল থেকেই দেখা গেছে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সরকারি দল মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করে পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন করে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত বাঙালিদের এই সরকার অস্বস্তিতে ফেলে পাকিস্তানি শাসকদের। তাই ফজলুল হককে ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী বলে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে প্রো-ভারতীয় ও অ্যান্টি-ভারতীয় দুটো লবি প্রকাশ্য হয়ে যায়।

অ্যান্টি-ভারত লবি সব সময় অভিযোগ করত, আওয়ামী লীগ ভারতের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। ভারতের আনুকূল্যে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন এলে এক পক্ষের ভারতবিরোধী প্রচার চলত। ফলে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের সখ্য অনেক বেশি। ধারণা করা হতো, কংগ্রেস সরকারের সময় আওয়ামী লীগ চলমান সমস্যার অনেকটা নিষ্পত্তি করতে পারবে। কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময় তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কিছুটা অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু নানা কূটচালে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠন করলে বাংলাদেশের অ্যান্টি-ভারত লবি উৎফুল্ল হয়েছিল। কিন্তু মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভিন্নভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে থাকেন। দূরদর্শিতা দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করেন। মোদির বক্তব্য ও নীতিনির্ধারণ বলে দেয়, তিনি শুধু বিশাল ভারতের নন, সার্কভুক্ত দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব অঙ্গনে একটি নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছাতে চান। নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর, তাঁর বক্তব্য এবং নীতিনির্ধারণ সে ইঙ্গিতই বহন করছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি অঙ্গনেও এই মেসেজ পৌঁছে গেছে। ক্ষমতার রাজনীতির দ্বন্দ্বে যাঁরা সক্রিয় থাকেন, সেসব পক্ষ বুঝে গেছে, ভারতের আশীর্বাদ ছাড়া ক্ষমতার পালাবদল সহজ নয়। তাই ভারতবিরোধী রাজনীতি হঠাৎ করেই ইউটার্ন নিয়েছে।

এসব কারণে আমরা মনে করি, নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নানা মাত্রিকতা পেয়েছে। প্রথমেই আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসা। মোদির বাংলাদেশ সফরের ঘোষণা থেকেই এই পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। বিএনপির অগোছালো আন্দোলনের ব্যর্থতা ও আওয়ামী লীগের সদম্ভ অবস্থান বিএনপিকে বাস্তব চিন্তায় ফিরে আসতে বাধ্য করেছে। সব ব্যাপারে বিরোধিতা করা ও একগুঁয়ে মনোভঙ্গিতে চলা রাজনীতিতে সব সময় শুভফল বয়ে আনে না। যেটুকু স্থিতিস্থাপকতা প্রয়োজন, বিএনপি তা দেখাতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি। পরবর্তী সময়ে এই অভ্যাস রাজনীতিতে কিছুটা প্রতিফলিত হলে তা আমাদের জন্য বড় পাওয়া হবে। বিএনপির নেতারা মোদির সফরকে স্বাগত জানাবেন বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে একপর্যায়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সফরে তিস্তা চুক্তি না হলে বিএনপি এর সমালোচনা করবে। বিএনপি সেই সমালোচনা থেকে নিজেদের বিরত রেখে আরেকটি স্বস্তি উপহার দিয়েছে।

মোদির এ সফর ও বিভিন্ন চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কতটা কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি অর্জন করতে পেরেছে, কতটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে, তা পরিষ্কার হতে আরো সময় লাগবে। তবে সাধারণ বিচারে এই সফরকে ইতিবাচক ও ঐতিহাসিক বলার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা ঠিক হবে না। অনেক প্রশ্ন থেকে যায় : চুক্তি হলেই তা বাস্তবায়িত হবে কি না, সমঝোতা স্মারকের পরিণতি কী, প্রকৃত অর্থে ভারতকে নানা ক্ষেত্রে সুবিধা দিয়ে আমাদের প্রাপ্তিটুকু বুঝে নিতে পারছি কি না—এসব প্রশ্ন থাকবেই। পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদির আগে বাংলাদেশের দাবি, রাজনৈতিক-সামাজিক ও বাণিজ্যিক প্রশ্ন এসব নিয়ে বিস্তারিতভাবে ভাবনা রাখার অবকাশ দেখায়নি ভারত। সেদিক থেকে অনেক বেশি অগ্রগতি হয়েছে মোদির সফর সূত্রে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে সময়ের বাস্তবতায় মোদি কিছুটা মূল্যায়ন করেছেন। আমরা মনে করি, এটি এ সফরের একটি বড় প্রাপ্তি। মোদি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করেছেন। মোদি অনুভব করেছেন, বাংলাদেশ এখন ভারতের মুখাপেক্ষী থাকার মতো দুর্বল দেশ নয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা বাংলাদেশের গুরুত্বকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মোদি সরকার স্পষ্টই অনুধাবন করেছে, সেভেন সিস্টার্স বলে পরিচিত রাজ্যগুলো বাণিজ্যিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। যে কারণে শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর অঙ্গীকারকে মোদি গুরুত্বের সঙ্গে প্রশংসা করেছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়কে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে ভারতকে। আমাদের মনে হয়, এই দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বলে মোদি সরকার বাংলাদেশের চাওয়াকে অতিক্রম করে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কোনো দেশে ভারতের ঋণ প্রতিশ্রুতি এটিই সবচেয়ে বড়।

দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, সীমান্ত সংকট নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সামুদ্রিক অর্থনীতি, সাধারণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা, আন্তযোগাযোগ, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি উঠে এসেছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথচলায় এসবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।

লক্ষণীয়, নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করবেন, তা বাংলাদেশে আসার আগে তাঁদের লোকসভার সমর্থন নিয়ে শক্তভাবেই এসেছেন। তিস্তা চুক্তির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সায় থাকা না-থাকার প্রশ্ন জড়িত বলে মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আস্থায় রাখার সব রকম চেষ্টা করেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশে বক্তব্য রাখতে হবে, তা মোদির জানা। ফলে শেষবারের মতো আরেকটু নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য বাংলাদেশে এসেই মোদি মমতার সঙ্গে আরেক প্রস্থ কথা সেরে নিয়েছিলেন।

সব দিক বিচারে আমরা মনে করি, নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নানা মাত্রা দিয়েছে। প্রতিটি দেশের সরকার যার যার দেশের লাভালাভের হিসাব করবেই। এর ভেতর থেকেই নিজেদের অর্জনটা বুঝে নিতে হবে। মোদি সম্পর্কের যে বদ্ধ অর্গলটি খুলে দিয়েছেন, তা থেকে লাভের ফসল ঘরে তুলতে বাংলাদেশ পক্ষের অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে এবং দরকষাকষির দক্ষতায় পা ফেলতে হবে। এতে শুধু বর্তমানের প্রাপ্তি নয়, ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রার পথ তৈরি করে নেওয়া সম্ভব।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়