মোদি সফর

ভারত, কোথায় মৈত্রী কোথায় বৈরিতা

Looks like you've blocked notifications!

নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে উপলক্ষ করে দেশের এক দল ভারত-প্রীতির, আরেক দল ভারত-বিদ্বেষের প্রমাণ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যাঁরা প্রীতি দেখাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই স্বাধীন মানুষের সত্তা এবং আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভারত রাষ্ট্রের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছেন। নদীর পানি না দেওয়া, সীমান্তে মানুষ গুলি করে মারা, পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি, বাংলাদেশের গুণ্ডাদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া, নির্বিচার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোসহ ভারতের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোকে তাঁরা যেন বিবেচনাই করতে চাইছেন না।

একইভাবে যাঁরা ভারত-বিদ্বেষ প্রদর্শন করছেন, তাঁরাও খেয়াল রাখছেন না যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, দরকষাকষি করেই নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে হবে বা সীমান্তে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার পথ বন্ধ করতে হবে। এই একবিংশ শতকের বিশ্বপরিস্থিতি বলছে, বড় রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র দরকষাকষি। আর তা চলতে পারে নীতিগত অবস্থান বজায় রেখেই। সম্প্রতি কিউবা-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এমনই এক নজির।

ভারত বাংলাদেশের ‘জাতশত্রু’ কিংবা ‘রক্তসম্পর্কের আত্মীয়’ এমনটি বিবেচনা না করে, ভারতকে একটি ‘শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করাই সংগত। মনে রাখা উচিত, ভারত বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে, হাজারো ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছে বাংলার মুক্তির জন্য, ২০০৭ সালে সিডর ঘূর্ণিঝড়ের পর ভারতের আপত্তির কারণেই আমেরিকার সেনারা বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে পারেনি, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকট ও দুর্যোগের মোকাবিলায় বহু সহায়তা করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি। তা ছাড়া দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর ভারতে গিয়ে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছে।

রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্র বাংলাদেশের এই সহযোগিতা ও বিরোধের বিষয়গুলো খুবই প্রকাশ্য। এ নিয়ে জল ঘোলা করার কিছু নেই। সমস্যা যদি কিছু থেকে থাকে, তা বাংলাদেশের সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর। পানি, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্তে হত্যা, গরু আমদানি-রপ্তানি, টেলিভিশন চ্যানেল প্রদর্শন, ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট, বন্দর, খনিজ সম্পদ, সুন্দরবন, পারমাণবিক চুল্লিসহ রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্র বাংলাদেশের যেসব সমস্যা আছে, তা নিয়ে দরকষাকষি তো বাংলাদেশকেই করতে হবে। দুই দিনের (৬ ও ৭ জুন-২০১৫) সফরে বিভিন্ন বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদি সমস্যাগুলোর কথা বলেছেন। সে তুলনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া বা রওশন এরশাদ কিছুই বলেননি। সবাই মিহি গলায় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কথা বলেছেন। বাকি ইস্যু বাদ। ইন্ডিয়ার প্রতি বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়াও তেমন কিছু নেই।

জানা গেছে, এ দুই দিনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ঠিকঠাক করেছেন ভারতীয় আধিকারিকরা। ভারত ট্রানজিট চায়, সে ক্ষেত্রে অভিন্ন ৫৪টি নদীর জল ভাগাভাগিকে পূর্বশর্ত হিসেবে যোগ করা যেতে পারত। ভারতের বাজারে আরো বেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের দাবি করাই যেত। মৌসুমে তুলা দিতে প্রায়ই টালবাহানা করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এটা নিয়ে দফারফা করার দাবি উঠতে পারত। ভারতের ভিসা পেতে বাংলাদেশিদের যে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে, তার সমাধানের জন্য উচ্চবাচ্য করলেও দোষ হতো না। বাংলাদেশের ভেতরে যেভাবে হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক চাকরি করছেন, তেমনি বাংলাদেশিদেরও ভারতে চাকরি করতে দেওয়া হোক, এমন দাবি করাও ভুল হতো না।

বাংলাদেশ ভারতের রিলায়েন্স ও আম্বানি কোম্পানি দুটিকে বাংলাদেশে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। বিনিময়ে ভারতেও দুটি বাংলাদেশি কোম্পানির কারখানা স্থাপনের অনুমতি চাওয়া যেতে পারত। শোনা যাচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে, সে ঋণ দিয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পে নাকি বহু ভারতীয়ের চাকরি নিশ্চিতের জন্য চাপ দিচ্ছে ভারত সরকার। এ চাপ অগ্রাহ্য করার জন্য সরকারের তাকত থাকলেই হবে না, যুক্তিও থাকা বাঞ্ছনীয়।

১৯০৮ সালে পাবনায় প্রাদেশিক সম্মিলনীতে দেওয়া বক্তব্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গল্প বলেছিলেন। গল্পটি এমন : ছাগশিশু একবার ব্রহ্মার কাছে গিয়া কাঁদিয়া বলিয়াছিল, ‘ভগবান, তোমার পৃথিবীতে আমাকে সকলে খাইতে চায় কেন?’ তাহাতে ব্রহ্মা উত্তর করিয়াছিলেন, ‘বাপু, অন্যকে দোষ দিব কী, তোমার চেহারা দেখিলে আমারই খাইতে ইচ্ছা করে।’ ওই ভাষণে তিনি আরো বলেন : ‘পৃথিবীতে অক্ষম বিচার পাইবে, রক্ষা পাইবে, এমন ব্যবস্থা দেবতাই করিতে পারেন না। ভারত মন্ত্রীসভা হইতে আরম্ভ করিয়া পার্লামেন্ট পর্যন্ত মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও ইহার যথার্থ প্রতিবিধান হইতে পারে না। সাধু ইচ্ছা এখানে অশক্ত। দুর্বলতার সংস্রবে আইন আপনি দুর্বল হইয়া পড়ে, পুলিশ আপনি বিভীষিকা হইয়া ওঠে। এবং যাঁহাকে রক্ষাকর্তা বলিয়া দোহাই পাড়ি, স্বয়ং তিনিই পুলিশের ধর্মবাপ হইয়া দাঁড়ান।’

দুর্বলের বিপত্তি নিয়ে এর চেয়ে অম্লমধুর বর্ণনা বাংলা ভাষায় বোধকরি আর নাই। দুর্বলরা যদি নিজে নিজেকে রক্ষায় সচেষ্ট না হয়, তবে ক্ষমতাবানদের হাতে তার অনিষ্ট চিরনিশ্চিত। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ সত্যের ব্যতিক্রম হবে, তার জো নেই। তাই নিজের গতরে যেমন শক্তি বাড়ানো দরকার, তেমনি বুদ্ধিতেও দরকার শান। নিজেরা চিরনির্জ্ঞান হয়ে থাকলে, কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জনে কুঁড়োমি করলে, দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্যে পিছিয়ে পড়লে বাংলার পতন ঠেকায় কার সাধ্য! বাঘের আক্রমণের মুখে কেবল লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে বাঁচার আশা ক্ষীণ। লাঠি চালানোর কৌশলটিও জানা চাই।

বাংলাদেশের সরকারি আধিকারিকরা কেন ভারতের আধিকারিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা অনুসন্ধান জরুরি। বাংলার বুর্জোয়ারা কেন ভারতীয় বুর্জোয়াদের জন্য বিদ্যুৎ খাত ছেড়ে দিলেন বা দিতে দিলেন, তা নিয়ে তাদের নিজেদের বোঝাপড়া জরুরি। ভারত বাংলাদেশে চোরাপথে গরু দিতে না চাইলে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব মূল্যে গোমাংস আমদানি করা যায়, সে নিয়ে আলাপ হলে ক্ষতি ছিল না। যে বুদ্ধিজীবী বা পণ্ডিতরা স্বজাত্যবোধ ছেড়ে, আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের খাতিরে ভারতের হাতে দেশের শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার কর্তৃত্ব তুলে দেওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছেন, সেসব ব্যক্তিকে নিয়ে সঠিক অনুসন্ধান ও সচেতনতা প্রয়োজন। ভারতের সিরিয়াল, চলচ্চিত্র, কার্টুন ছবি দেখে বাংলার শিশু-কিশোররা বখে যাচ্ছে বলে যাঁরা মনে করছেন, তাঁরা বিকল্প কী নির্মাণ করছেন বা কী উপায় তৈরি করছেন, সেটি বিবেচ্য। এ জন্য তৎপরতা প্রয়োজন তাঁদের, যাঁরা বাস করছেন বাংলাদেশে।

নরেন্দ্র মোদি ৭ জুন সন্ধ্যার বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে ভারত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে তিনি বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছেন। বাংলাদেশও কি বিনিময়ে কিছু চাইতে পারে না?

সময় সময় ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতা এমন রূপ নেয় যে ঠিক বোঝা যায় না, বিদ্বেষ কার বিরুদ্ধে—রাষ্ট্র ভারত, বুর্জোয়া ভারত, ভারতের সব জনগণ নাকি ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার জোটের শরিকরা যে ভারতের বিরোধিতা করে এবং কট্টর বামপন্থীরা যে ভারতের বিরোধিতা করে, তা কি এক? ইসলামপন্থীরা যে ভারতের বিরোধিতা করে এবং দেশের বুর্জোয়াদের একাংশ যে ভারতের বিরোধিতা করে, তা কি এক ও অভিন্ন? যদি না হয়ে থাকে, তবে পরিষ্কার করা দরকার, ভারতের কোন সত্তাটির বিরোধিতা করা প্রয়োজন এবং কেন।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই শ্রমিক-কৃষক। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। এসব মানুষের দারিদ্র্য, যন্ত্রণা, বেদনা দূর করতে কোন ভারতের বিরোধিতা এবং কোন ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে, তার একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন বাংলার মুক্তি-সংগ্রামের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। একদল শত্রু তাঁকে বলত ‘ভারতের দালাল’, আরেক দল বলত ‘গোঁড়া ইসলামপন্থী’। যদিও মুচকি হেসে নিজেকে ‘খাইটা খাওয়া গরিব মানুষ’ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন তিনি।

১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল নরসিংদীর শিবপুরে কৃষক সমিতির কর্মী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘বাংলার কৃষক, তোমরা প্রস্তুত হও। দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষ, দুনিয়ার মজলুম মানুষ, দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষ, শোষিত মানুষকে তোমরা মুক্ত করো—আমরা মুক্ত করবই করব।

‘শুধু বাংলাদেশের কৃষকের জন্য আমরা কৃষক সমিতি গঠন করি নাই, শুধু বাংলাদেশের কৃষকের মুক্তির জন্য কৃষক সমিতি গঠিত হয় নাই, দুনিয়ার কৃষক, দুনিয়ার মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য বাংলার কৃষক সমিতি গঠন করা হয়েছে।

‘ভারতের কৃষকের দুঃখ, ইরানের কৃষকের দুঃখ, বার্মার কৃষকের দুঃখ, নেপালের কৃষকের দুঃখ, ভুটানের কৃষকের দুঃখ, কাবুলের কৃষকের দুঃখ, বাংলাদেশের কৃষকের দুঃখ—এক দুঃখ। এক মানুষ, এক আত্মা, এক দেহ। মনে-প্রাণে তোমরা কৃষক সমিতির কাজ করে যাবে।

‘ভাষার দৃষ্টিকোণে আমরা বাঙালি, তবে বাংলাদেশের কৃষক সমিতি বাংলার ভৌগোলিক রেখার ভিতর সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমাদের আন্দোলন, আমাদের সংগ্রাম সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষ, শোষিত মানুষ, নিপীড়িত মানুষ, কৃষক-মজুরের মুক্তির জন্য।’

ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ চাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির জন্য; বাণিজ্য বিস্তারের জন্য নয়।

৭ জুন ২০১৫

লেখক : সাংবাদিক