আন্তর্জাতিক

মোদির সফর সৌহার্দ্যের দরজা খুলে দিয়েছে

Looks like you've blocked notifications!

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রথমটি হলো, ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং দ্বিতীয়টি হলো, ঢাকা সফরের সময় পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢাকায় অবস্থান করানো। স্থলসীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে মোদি আসাম ও পশ্চিম বাংলায় নিজের দলের বিরোধিতাকারীদের নিরপেক্ষ অবস্থানে আনার মাধ্যমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছেন এবং দুই মুখ্যমন্ত্রী আসামের তরুণ গগৈ ও পশ্চিম বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দৃশ্যপটে হাজির করেছেন। মোদির ঢাকা সফরের সিদ্ধান্তে প্রজ্ঞার ছোঁয়া ছিল। তাঁর এ সফরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত ছিল, একটি স্থলসীমান্ত চুক্তি এবং আরেকটি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি।

তিস্তা চুক্তি অসমাপ্ত থেকে গেল। মোদির সফরের সময় মমতার স্বাধীনভাবে ঢাকা সফরের সিদ্ধান্ত এবং তাঁকে বহনকারী বিশেষ বিমানবহরে মমতার অংশগ্রহণ না করা ও ভিন্ন হোটেলে অবস্থান কোনো দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা নয়। মোদির নৈকট্য এড়িয়ে গিয়ে মমতা তাঁর নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করলেন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিলেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কালো ছায়া তিস্তা চুক্তির ওপরে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে মমতার সহযোগিতা তিস্তা চুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মমতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মমতা ঢাকায় যে প্রটোকল পেয়েছেন, তা একজন সরকারপ্রধানের সমান। মমতার ঢাকায় অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা তাঁর ক্ষমতার সাত বছরে বরাবরই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে পথপ্রদর্শক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভারতবিরোধী বিদ্রোহীদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, যারা বাংলাদেশকে স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছিল। তাদের কিছু নেতাকে তিনি ধরতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট ভারতবিরোধী শক্তিকে বিনাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি মুসলিম জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমন করতে পেরেছেন। ভারতের সঙ্গে দুটি চুক্তি করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছে। মোদি তাঁর ঢাকা বিবৃতিতে স্পষ্ট করছেন যে, তিস্তার পানির ন্যায্য এবং ন্যায়সংগত বন্দোবস্ত হবে। রাজ্য সরকারের সমর্থনে সেটি বাস্তবায়ন হতে হয়তো বা খুব বেশি দিন লাগবে না।

মোদির সফরে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় দেশই সন্ত্রাসবাদ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তাঁরা স্বাক্ষর করেছেন মানবপাচার, জাল নোট এবং মাদকদ্রব্য চোরাচালান রোধে। আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা এবং গুয়াহাটি-শিলং-ঢাকা দুটি নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি ও শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল। সে সময় বাজপেয়ি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ২০০৮ সালে ঢাকা-কলকাতা যাত্রীবাহী ‘মৈত্রী’ ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছিল। এ ছাড়া আরো যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারতীয় জাহাজ চলাচলের অনুমতি, বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা, কোস্টগার্ডদের মধ্যে সহযোগিতা এবং আইটি ও সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের কাছে ৬০০ একর জমি অধিগ্রহণের যে চুক্তি হয়েছে, তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত রচনা করেছে। এর ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ‘বাংলাদেশে তৈরি’ পণ্য উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি এবং বাইরে আমদানির ইচ্ছা তাঁদের সহযোগিতা করবে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে অর্থনীতি একীভূবন হবে এবং সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে। সহজলভ্য স্থানীয় কাঁচামালের জন্য বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর এই সংযোগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তারা যদি ডুয়েলগেজকে ব্রডগেজ কোচ এবং ওয়াগনে পরিণত করে তা দ্বারা ভারতও লাভবান হবে। মোদি যে ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তা এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করবে। আন্তর্দেশীয় নৌ-বাণিজ্য এবং ট্রানজিট নবায়িত হয়েছে।

আন্তর্দেশীয় নৌপথের মাধ্যমে পশ্চিম বাংলা, বাংলাদেশ ও আসামের অনেক বন্দর সংযুক্ত আছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য জোরদার হতে পারে। সর্বোপরি সীমান্তের হাটগুলো উন্মুক্ত করা যেতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে শুল্ক বাধা অপসারণ করতে হবে। মোদি এগুলোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। দেশটি উপমহাদেশের পূর্বাংশে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। দেশটি অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে এবং এর জিডিপি বছরে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। মোদি ও হাসিনার মেয়াদের আরো চার বছর রয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য। মোদির সফর পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার আবারো উন্মোচন করল এবং দুটি দেশকে আরো কাছাকাছি আনতে সহযোগিতা করবে।

 

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার।

টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে ভাষান্তর : অনিন্দ্য আরিফ