শিক্ষা

শুধু জিপিএ ৫ নয়, শিক্ষা হোক উপভোগ্যও

Looks like you've blocked notifications!

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় তুলনামূলক খারাপ ফল হয়েছে। গণহারে পাসের ঘটনা এবার ঘটেনি। কমেছে জিপিএ ৫-এর সংখ্যাও। এর অন্যতম কারণ, গণিতে ফল বিপর্যয়। তাই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ কম। গণিতে এবার সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। নতুন প্রবর্তিত নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। যথাযথ পদ্ধতিতে পাঠদানে ব্যর্থ হয়েছেন শিক্ষকরাও। ফল বিপর্যয়ের এ ঘটনা আবারো প্রমাণ করে দিল, শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের আরো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, প্রয়োজন সংস্কারও।

এবার গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আটটি সাধারণ বোর্ডের অধীনে গড় পাসের হার ৮৬ দশমিক ৭২ শতাংশ, যেখানে মাদ্রাসা বোর্ডে ৯০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০১৪ সালে গড় পাসের হার ছিল ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যার মধ্যে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ; মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৯ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৮১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শিক্ষা বোর্ড, সরকারের কর্তা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, গতবারের চেয়ে ফল খারাপ হয়েছে এবং এ জন্য তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনকে দায়ী করছেন। কিন্তু ফলাফলের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হওয়ায় গণিতে কোনো কোনো বোর্ডে ১২ শতাংশের মতো কম পাস করেছে এবং গণিতে গড় পাসের হার কমেছে ৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছরের সঙ্গে গণিতের ফল তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে কুমিল্লায় ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশের কম পাস করেছে। এবার এই বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ; চট্টগ্রামে কমেছে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এই বোর্ডে গণিতে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া যশোর বোর্ডে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৮ দশমিক ৭৭ ও রাজশাহী বোর্ডে গণিতে গতবারের চেয়ে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ কম পাস করেছে। অপর পক্ষে ইংরেজি ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত পাস করেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে যেসব শিক্ষক শিক্ষা প্রদান করছেন, তাঁরা এ পদ্ধতির জন্য যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত নন। শিক্ষার্থীদের কাছেও পদ্ধতিটি নতুন। কাজেই সৃজনশীল পদ্ধতিটি কার্যকর হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সর্বমোট ২৩টি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে, তার মধ্যে শারীরিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও খেলাধুলার মতো নতুন বিষয়ও রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে গণিত নিয়ে। মূলত গণিত বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকের অভাব ছিলই, বর্তমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এ থেকে উত্তরণে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষ করতে হবে; শিক্ষকরা প্রাইভেট, কোচিং ও বাইরে পড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ, এভাবে তাঁরা অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। ক্লাসরুমে বেশি সময় দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকরা নিজেরাও দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেমন উৎসাহ পাবে, তেমনি তারা পড়ার সময় যেসব সমস্যার সস্মুখীন হয়, সেগুলোর সমাধান পেয়ে যাবে; বাড়বে শিক্ষার মান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাসের হার বাড়ানো, জিপিএ ৫ পাওয়া নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত। এ নিয়ে এত মাতামাতি বা বাগাড়ম্বর কেন? শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষার মান নিয়ে তাঁরা কোনো কথা বলছেন না। শিক্ষাব্যবস্থার এই অন্তঃসারশূন্যতা শিক্ষার্থীদের জীবনকে আজ বিপন্ন করে তুলছে; জানা-বোঝার চেয়ে সনদনির্ভরতা আমাদের শিক্ষার্থীদের বোধ-বুদ্ধি, চিন্তা, মনন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথকে একদিকে যেমন রুদ্ধ করছে, করছে জটিলও। আমরা আগেও বলতে চেয়েছি, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে আনন্দদায়ক করার পাশাপাশি করতে হবে উপভোগ্য। বছরের প্রথমে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। সে বইয়ের যথাযথ ব্যবহার বা তা থেকে যে জ্ঞান অর্জনের কথা, তা হচ্ছে কি না, কেউ খবর রাখছে না। আসলে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না। তার প্রমাণ মিলছে শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তির জন্য বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত ফল করতে পারছে না।

কোনো সংস্কার বা পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে প্রয়োজন উপযোগী পরিবেশ তৈরি। সৃজনশীল পদ্ধতি নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী একটি পন্থা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফলের আগে শিক্ষকদের পারদর্শিতা পূর্বশর্ত। বিশেষত মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা অর্জন অপরিহার্য। বিদ্যমান পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সর্বস্তরের শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, রিসার্স ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন।