শিক্ষা
অনলাইনে ভর্তি বিড়ম্বনা
হঠাৎ করেই আমার কাজিন স্বপ্নের ফোন পেলাম। বয়সে অনেক ছোট হলেও ও আমায় বন্ধু বলেই মনে করে। তাই ওর পাওয়া না-পাওয়ার কথাগুলো শোনার একমাত্র মানুষ আমি। ওই দিন ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে আমায় বলল, ‘দিদি, অনলাইনে আমার ভর্তির ফরমটা কে যেন আগে থেকেই পূরণ করে রেখেছে। আমি তো আমার ফরমটা পূরণ করতে পারছি না।’ গল্পটি আমার বোন স্বপ্নের নয়। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া অনেক কিশোর-কিশোরীর গল্প। এসএসসি রেজাল্টের পরেই খুব স্বাভাবিকভাবে কলেজে ওঠার স্বপ্ন ছিল অনেকের মনে। কিন্তু এই স্বপ্ন এখন অনেকের কাছেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে অনলাইন ভর্তি বিড়ম্বনার কারণে। অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এর পেছনে দায়ী বিভিন্ন কারণ। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে আমরা দায়ী করতে পারি ভর্তি জালিয়াতিকে। আর দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই ভর্তি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দেশ গড়ার কারিগর শিক্ষক। অথবা যে মানুষগুলোর ওপর ভরসা করে আছে কিশোর-কিশোরী, সে রকম কোনো নিকট আপনজন।
অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই তাদের নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্তটুকু ঠিকমতো নিতে পারছে না। স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকরা তাঁদের ভালো ছাত্রছাত্রী হাতছাড়া না করার উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন জালিয়াতি। শুধু রোল নম্বর, পাসের সাল, বোর্ডের নাম দিয়ে লগইন করলে যে কেউ রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে। আর প্রযুক্তিগত এ দুর্বলতার সুযোগটাই নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। শিক্ষকরা তাদের গোল্ডেন এ-প্লাস প্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার জন্য চয়েজ ফরমের প্রথম পাঁচটি কলেজের প্রথম পছন্দ হিসেবে দিয়েছে নিজের কলেজের নাম। তাই শিক্ষার্থী নিজে যখন এই ফরমটি পূরণ করতে যাচ্ছে, তখন ‘ইউ হ্যাভ অলরেডি অ্যাপ্লাইড’—এই অনাকাঙ্ক্ষিত মেসেজটি এসে তার পছন্দের কলেজে পড়ার স্বপ্নকে চিরতরে নষ্ট করে দিচ্ছে। আর তাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তখন বেছে নিতে হচ্ছে সেই কলেজকে। তবে এই ইঁদুরদৌড়ে প্রকৃত অর্থে শিক্ষার মান কতটুকু উন্নত হচ্ছে, এ নিয়ে সন্দেহ আছে অনেক শিক্ষাবিদেরই। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা বলতে যে জ্ঞান অর্জনকে বোঝায়, সেটা তো হচ্ছে না; বরং ফলভিত্তিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সবাই।
একজন শিক্ষার্থীকে যখন গোল্ডেন এ-প্লাস নামক দৌড়ে নাম লেখাতে হচ্ছে, তখন তার সৃজনশীলতা শুধু বাধাগ্রস্ত হয় না, বরং হুমকির সম্মুখীন হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রেই অনলাইন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন না করেই সে প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। যার ফল এই অনলাইন ভর্তি বিড়ম্বনা। অদক্ষদের দ্বারা ত্রুটিপূর্ণ গেটওয়ে নির্মাণ করার কারণে অনেকেই সাইবার ক্রাইমের মতো গুরুতর অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু তার পরও একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে আশা করতেই পারি, ত্রুটিপূর্ণ গেটওয়ে নির্মাণের কারণে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, তা শুধরে নেওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উচিত, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেওয়া। আর ছোট ছোট ভুল থেকেই হয়তো নতুন করে শিক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে। তাই এখন রোল নম্বরের পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশন নম্বরও যুক্ত করা হয়েছে, যাতে করে শিক্ষা বোর্ডের বেশ কয়েকজনই জালিয়াতি কমে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া জালিয়াতদের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগ খতিয়ে দেখার কথা তাঁরা অনেকেই বলেছেন। তবে রাজধানীর কয়েকটি কলেজ এ রকমভাবে চয়েজ ফরম পূরণ না করে বরং পরীক্ষা নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী নেওয়ার পক্ষপাতী, যেমন : নটর ডেম কলেজ, হলিক্রস কলেজ ও সেন্ট যোসেফ কলেজ।
তবে যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে হলে কতগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, অনলাইনে ভর্তি আমাদের দেশে নতুন কোনো ইনোভেশন নয়, এর আগেও অন্যান্য অনেক উন্নত দেশে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়, একজন শিক্ষার্থী সম্পর্কে যত বিস্তারিত তথ্য নেওয়া যাবে, তত এই জালিয়াতি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, সেশনের সঙ্গে যদি মায়ের নাম, বাবার নাম, জন্মতারিখ, রক্তের গ্রুপ, আঙুলের ছাপ, ফিজিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন, যেমন : তিল, জন্মদাগ এ রকম কিছু বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকে এবং কেউ কোনো ভুল তথ্য দিলে আগে থেকেই সিস্টেমে যদি তার সব তথ্য আপলোডেড থাকে, তবে ভুল তথ্য সহজেই ধরা পড়বে। আর এ তথ্যগুলো এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনেই বোর্ডের কাছে সংরক্ষিত থাকবে এবং কোন জায়গা থেকে ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেই সার্ভার আইপি চিহ্নিত করার মাধ্যমে জালিয়াতি চক্রকেও ধরে ফেলা সম্ভব হবে।
আমাদের অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া সফল করতে হলে আটঘাট বেঁধেই নামতে হবে। না হলে এর ফাঁকফোকরে পড়ে বঞ্চনার শিকার হবে অনেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে আমি মনে করি, স্কুল পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্যসহ একটি কম্পিউটার কোর্স বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থী নিজেও এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারবে। কারণ যার জন্য আমি প্রযুক্তি প্রবর্তন করছি, সে যদি প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকে, তবে তা সমস্যা তৈরি করবে। আর একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, রাষ্ট্র যদি নতুন কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায়, তবে জনগণকে আগে সে ব্যবস্থার উপযোগিতা গ্রহণের জন্য দক্ষ করে তুলতে হবে। না হলে তা কখনোই জনকল্যাণে কাজে লাগবে না।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর