প্রতিক্রিয়া

বর্জ্য অপসারণে পলিব্যাগ, একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

Looks like you've blocked notifications!

পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে হলে পরিবেশবান্ধব বস্তুই ব্যবহার করতে হয়, একজন সাধারণ মানুষও এ বিষয়টি খুব ভালো করে জানেন। অথচ পরিবেশকে বর্জ্যমুক্ত রাখতে নতুন বর্জ্য তথা নিষিদ্ধ পলিব্যাগ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এটিকে আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! ১৭ জুন রাজধানীর নাজিরাবাজারে নবনিযুক্ত মেয়র সাঈদ খোকন প্রকাশ্যে যেভাবে পলিব্যাগ বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন, তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে পারা গেল না।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের গতিশীলতা ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গণহারে সবাইকে পলিথিন ব্যাগ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯ মে রাজধানীর গুলিস্তানে কাজী বশির মিলনায়তনে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সম্মানিত মেয়র শবে বরাতের আগে শতভাগ সড়কবাতি ও গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণে বিনামূল্যে পলিব্যাগ বিতরণ করার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৭ জুন প্রকাশ্যে পলিব্যাগ বিতরণের আয়োজন করা হয়।

পলিথিনের ব্যবহার মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালে। আমরা নিশ্চয়ই বিস্মৃত হইনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ থেকে পরিবেশদূষণকারী পলিব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ ও অপসারণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সরকার।  পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় মাটিতে মেশে না। মাটির সঙ্গে মিশতে এর ১০০ থেকে ৪০০ বছর সময় লাগে। রাসায়নিক গঠনের কারণে এটি পানি ও অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। পলিথিনের ধোঁয়া মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে। এমন আরো অনেক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ পরিবেশ আইন-১৯৯৫ (২০০২ সালের ৯ নম্বর আইন দ্বারা সংশোধিত)-এর ৬ক ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার যেকোনো প্রকার পলিথিন শপিংব্যাগ বা পলিথিলিন বা পলিপ্রপাইলিন থেকে তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে এরূপ সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ মার্চ সারা দেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৩ সালের মধ্যে বিশ্বের ১৭টি দেশে এটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, যেখানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো), গ্রিন পিস ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রেন্ডস অব দি আর্থ, আইপিইএনসহ আরো অনেক পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠান। এখন বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইন্ডিয়া, তাইওয়ান, আমেরিকা, কেনিয়াসহ আরো অনেক দেশে ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক প্লাস্টিকমুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে, ২০০২-এর পর থেকে ধীরে ধীরে পুনরায় পলিথিনের ব্যবহারে বাজার সয়লাব হয়ে ওঠে। এর যথেচ্ছ ব্যবহারে ব্যাপক আকার ধারণ করে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ; সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা, আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় তুরাগ, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভন্ন নদীর নাব্যতা। যার ভয়ানক ফলাফল আমরা আজো ভোগ করছি। পলিথিন ব্যবহারের কারণেই যে নগরীর পরিবেশ চরম হুমকির সম্মুখীন, তা ঢাকা নগরীর অলিগলি, রাস্তা আর ডোবা ও নষ্ট লেকের দিকে তাকালেই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বছর ঘুরতেই অসচেতন মানুষ সব ভুলে আবার এর ব্যবহার শুরু করে। বর্তমানে আগের থেকেও বিপুল পরিমাণে পলিব্যাগের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার পরিবেশ রক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি ২০০২ সালে খুব উদ্যমের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিল, তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন দেশের বিজ্ঞজনেরা। কিন্তু মাত্র ১৩ বছরের ব্যবধানে একই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে প্রকাশ পাবে, তা কল্পনাই করা যায় না।

২০০২-২০১৫ স্বপ্ন ছিল পলিথিন দূষণমুক্ত বাংলাদেশের; কিন্তু যখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ধ্বংসের হাতিয়ার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, তখন পরিবেশ বাঁচানোর পথ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। যেখানে ঢাকা শহরে পলিথিন ব্যাগ কারখানায় আজো অভিযান চালানো হয়, দোকানে দোকানে এর ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সেখানে দেশের একজন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি মিডিয়ার সম্মুখে ও তাদের ঐকান্তিক সহায়তায় এই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম প্রকাশ্যে চালানোর সিদ্ধান্ত কীভাবে গ্রহণ করলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। গণমানুষের যাঁরা প্রতিনিধি, তাঁদের অবশ্য প্রয়োজন সব বিষয়ে সজাগ ও অবহিত থাকা। তাঁদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত অগণিত মানুষের জীবন বিপন্নের কারণ হতে পারে।

পলিথিন কখনই পরিবেশবান্ধব নয়, যখন এটি নিজেই একটি ক্ষতিকর বর্জ্য, তখন কোনোভাবেই এটি বর্জ্য অপসারণের মাধ্যম হতে পারে না। বর্জ্য সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা নগরীর জন্য প্রয়োজন কঠোরভাবে বর্জ্য নির্মূল করে পলিথিন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধকরণ আইনের বাস্তবায়ন। পলিথিন ব্যবহার করে পরিবেশদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং প্রাকৃতিকভাবে তৈরি সুতা বা পাটের তৈরি দড়ি দিয়ে বানানো পরিবেশবান্ধব ও দ্রুত পচনশীল ব্যাগ ব্যবহার করে পরিবেশকে সুস্থ রাখার পরামর্শ দেওয়াই কর্তৃপক্ষের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।