ফলে রাসায়নিক দূষণ
চলছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানা রসালো ফলের মৌসুম। ভিটামিনে পূর্ণ এসব ফল আমাদের দেশে আমাদের জন্য কতটা নিরাপদ তা ভাবনার বিষয়। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের শেষের দিকে প্রায় ৩৯ রকমের কীটনাশক, ১০ রকমের তৃণনাশক, ১০ রকমের ছত্রাকনাশক ওষুধ বাংলাদেশের কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বছর বছর এই ক্ষতিকর কীটনাশকের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু টক্সিক কীটনাশক ও হরমোন। যেমন : ডিডিটি, এন্ড্রিন, বিএইচসি, এল্ড্রিন, ডায়েল্ড্রিন, হেপটাক্লোর, ক্লোরডেন, থায়োডিন ইত্যাদি। এসব ক্ষতিকর টক্সিক কীটনাশক পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যবহার ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের আমদানি ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
এসব ক্ষতিকর কীটনাশক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মান, ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য। ভারত থেকেও অবৈধ পথে প্রচুর কীটনাশক বাংলাদেশে আসে। ফল দ্রুত বৃদ্ধি ও পাকানোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য খুব দ্রুত আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। প্রবেশ করে আমাদের রক্তে। যার ফলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি জন্ডিস, ক্যানসার, অ্যাজমাসহ নানা রকম চর্মরোগে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সুবাদে কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েডের মতো সংক্রামক রোগ থেকে আমরা রক্ষা পেলেও খাদ্যের বিষক্রিয়ার ফলে আমাদের জীবন নাশ করছে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মতো নানা অসংক্রামক রোগ। কিডডিকে অকেজো করে দিচ্ছে এসব বিষাক্ত খাবার। এসব দূষিত খাবারের কারণে আমাদের দেশে জন্মগত প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলছে। মানুষ ভুগছে নানা রকম স্নায়বিক সমস্যায়। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের ফলের দোকানগুলো এসব বিষাক্ত ফলে সজ্জিত। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে এসব ফল বিষাক্ত। ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করার ফলে দুই, তিন মাস পরেও এসব ফলে পচন ধরে না। সতেজ মনে হয়। কিন্তু এসব ফল এত বেশি বিষাক্ত যে, কোনো পোকামাকড় বা মাছি এসব ফলের ওপর বসে না।
ফল উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত ছয় দফায় প্রয়োগ করা হয় নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব বিষাক্ত ফল খেয়ে লিভার ক্যানসার, কিডনি অকেজো, স্নায়বিক দুর্বলতা,পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যানসারসহ নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফরমালিনের ব্যবহার অনেক কমেছে কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো এ বছর ও অপরিপক্ব ফল পাকাতে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়েছে কার্বাইডসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আম, লিচুকে পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষতিকর কীটনাশক। লিচুকে আকর্ষণীয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষতিকর টেক্সটাইল কালার। আনারসে ব্যবহার করা হচ্ছে হরমোন, যা আরো মারাত্মক।
ফল ছাড়াও অন্যান্য খাদ্যে মিশ্রিত হচ্ছে নানা ক্ষতিকর পদার্থ। যেমন : দুধ ও মাছে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন, মিষ্টিতে মেশানো হচ্ছে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যবহৃত রং। জিলাপি ভাজা হচ্ছে মবিল দিয়ে, গুড় তৈরিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর হাইড্রেট, মুড়ি ভাজতে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউরিয়া। শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিষাক্ত ছোবল থেকে। শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধে মেশানো হচ্ছে মেলামিন, চকলেটে মেশানো হচ্ছে সিসা, জুস তৈরি হচ্ছে নানা ক্ষতিকর রঙের সংমিশ্রণে। অটিজম, হাইপার টেনশন, ব্লাড ক্যানসার, স্তন ক্যানসারের জন্যও ডাক্তাররা এসব দূষিত খাদ্যকেই দায়ী করছেন। ঢাকার খুব কাছেই ধামরাই অঞ্চলে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই অঞ্চলের কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কার্বনেটসহ অন্যান্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে ওই এলাকার মাটি ও পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ফলে ২০১২ সালে ওই অঞ্চলের অনেক শিশুর স্নায়বিক জটিলতা দেখা দেয় এবং অনেক শিশু মারা যায়। এসব দূষিত খাদ্য ধীরে ধীরে মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মানুষকে ধাবিত করে অকালমৃত্যুর দিকে। শুধু তাই নয়, গর্ভবতী মা ও শিশুর মারাত্মক ক্ষতি করছে এই দূষিত খাদ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের জীবনের সামগ্রিক মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
লেখক : শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়