কাটারবাজ গণমাধ্যম, অতঃপর আমরা
প্রায় সময়ই নাটক, সিনেমা, গল্পের বইয়ে শুরুর দিকে দেখবেন একটি ঘোষণা বা ডিসক্লেমার থাকে। সেটা হলো এ রকম যে, এই কাহিনীর সব চরিত্র, ঘটনা বা বিষয় কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিলে গেলে অনভিপ্রেত, সেটার জন্য কেউ দায়ী নয়। তবে এই প্রতিশ্রুতির সাথে কাজের মিল না থাকলে কিন্তু সেটার জবাবদিহি নির্মাতা বা রচয়িতাদের করতে হয়। ওই ডিসক্লেমার তখন আর ধোপে টেকে না।
মূল কথায় আসি বরং। হপ্তাখানেক আগে বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত সিরিজে বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতাপশালী মোড়ল ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় মিডিয়ার ক্রিকেট নিয়ে বাড়াবাড়ি সে দেশে কোন কালে শুরু হয়েছে তার ঠিকুজি বের করা মুশকিল-তবে এখন সেই বাড়াবাড়ি যে ভয়াবহ বেড়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশকে নিয়ে বহুভাবে কটূক্তি করা দেশটির গণমাধ্যমকে একহাত নেওয়ার সুযোগ এমনভাবে আগে আর আসেনি। ফেসবুক তার জন্য ছিল সেরা মঞ্চ। সে মঞ্চে একে অপরকে কটাক্ষ করার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
তবে গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যম নিঃসন্দেহে এক বিষয় নয়। গণমাধ্যম সবসময়ই সামাজিক দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করতে বাধ্য। চাইলেই যা ইচ্ছা তা লেখা যায় না, এমনকি সত্য হলেও তাতে ‘ক্রস চেকিং’য়ের বিষয় থাকে। কারণ মানুষজন গণমাধ্যমকে নিজেদের চেয়েও বিশ্বাস করে বেশি, সেইসাথে গণমাধ্যম থেকে উৎসারিত তথ্য বলুন বা বার্তা বলুন- নিজেদের মধ্যে ধারণ করে। সচেতনে বা অবচেতনে। কাজেই ‘যেমন খুশি তেমন করো’র অধিকার আর যাই হোক, কোনো গণমাধ্যমের নেই। শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে তেমন কাণ্ডই ঘটল। সিরিজ হারা ভারতীয় খেলোয়াড়দের মাথা আধখানা কামানো, উপরে মুস্তাফিজের ছবি, মুস্তাফিজের কাটারে কামানো হয়েছে খেলোয়াড়দের মাথা। এমনকি ছবিগুলো হাতে আঁকা কার্টুনও নয়-একদম ফটোশপে মেরেকেটে বানানো। আপামর পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, উল্লাসে আনন্দ করছেন। বিজয়ের জন্য উচ্ছ্বাসের পর্যায়টি আমরা স্যাডিজমে পরিণত করার দিকে ভালোই এগিয়েছি। এই কাটার দিয়ে মাথা কামানো ছবি ওই প্রবণতার পালে তুমুল হাওয়ার জোগান দিল। বিষয়টি ভারতীয় গণমাধ্যমের চোখ এড়ায়নি, ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে প্রতিক্রিয়ায়- স্বাভাবিকভাবেই। কারণ সামাজিক মাধ্যমের লাইন ছাড়ানো আঘাত, পাল্টা আঘাত আর গণমাধ্যমে নগ্ন কটূক্তি এক বিষয় নয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি হয়তো প্রথম আলো মাথায় নেয়নি, যে বিষয়টির বাজে প্রতিক্রিয়া এ দেশের সাধারণ মানুষ কারণে-অকারণে বিভিন্ন সময়ে হজম করবে, ভিক্টিমাইজ হবে। খেলোয়াড়দের কথা না হয় বাদই দিলাম। ভবিষ্যতে বাংলোদেশ যদি কখনো হেরে যায়- তার জবাব যে কেমন হবে কল্পনা করতেও ভয় হয়।
মিরপুরে ধোনি আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরবার পথে দর্শক ‘মওকা মওকা’ বলে বিদ্রূপ করেছিল। যে লোককে (মহেন্দ্র সিং ধোনি) নিয়ে রীতিমতো শত কোটি টাকা বাজেটের বায়োপিক বানানো হচ্ছে, তিনিও এর জবাব দিতে পারেননি মোটেও। কারণ, ‘মওকা মওকা’ বাংলাদেশি ওই দর্শকের আবিষ্কার নয়, ভারতীয় মিডিয়ারই আবিষ্কার। সে ক্ষেত্রে ধোনির আর কী করার আছে? এখন প্রথম আলোর ফটোশপ কারসাজি দিয়েও ঠিক একই কাজ করা হলো। ধরুন এরপর কোনোদিন বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যখন এর চেয়েও বাজে কোনো বিদ্রূপের শিকার হবেন, তারও কিছু বলার থাকবে না। কারণ ক্ষেত্রটি আজ বাংলাদেশি মিডিয়াই তৈরি করে দিল। প্রথম আলো তো ফটোশপ দিয়ে মুস্তাফিজ কাটারের মাধ্যমে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মাথা কামিয়েই খালাস। এর পরবর্তী যেসব ঘটনা ঘটছে বা ঘটবে সেটার দায়ভার কি তারা নেবে?
কোনটা পেশাদারত্ব আর কোনটা আবেগ- সেটার ব্যবধান বোঝার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের প্রায়ই হয় না। একই হাল যখন গণমাধ্যমেরও হয়, তখন তার সাথে মাসকাবারি বাজারের ফর্দের আর কোনো তফাত থাকে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই বাজারের ফর্দটি যদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হয়- যাদের কি না বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠি এ দেশে ‘পিপল উইল থিংক দ্য ওয়ে আই উইল টেল দেম টু থিংক’ মাত্রার; তখন আর কিছুই বলার থাকে না। কারণ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের একটা মাত্রা থাকে, সেই মাত্রা পেরোলে অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কি?
বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো না কোনো দেশের কাছে হারতেই পারে। তখন আমাদের প্রিয় খেলোয়াড়দের শরীরে যদি ফটোশপ দিয়ে লেজ জুড়ে তারপর সেটা তারে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বিদেশের কোনো শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায়- সেই অপমানটা এ দেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমী সইতে পারবেন তো? আর সেই অপমানের দায়ভার কি প্রথম আলো নেবে?
ভাবুন ভাবুন, সময় থাকতে ভাবার প্র্যাকটিস করুন।