স্মরণ

প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’—যিনি এ কথা উচ্চারণ করেন দৃঢ়ভাবে এবং সত্যি সত্যিই জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, তাঁর প্রথম সাধনা বাংলাদেশ এবং জীবনের শেষ রক্তবিন্দুর নাম বাংলাদেশ—তাঁর নাম জিয়াউর রহমান। এটি কোনো কল্প কাহিনী নয় যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ঘোষণার বীরোচিত সম্মান নিয়েই তিনি স্থির থাকেননি, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রণাঙ্গনে, ‘ধরেছেন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’। 

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে শত্রু সৈন্যের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম উচ্চারণ ছিল ‘উই রিভোল্ট’। নিজের সেনাদল নিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে করতেই বেলুনিয়া সেক্টর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁর দেশপ্রেম জীবনের প্রতি প্রেমকেও ছাড়িয়ে যায়। দেশের মাটি ও মানুষ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর সবকিছু। হয়তো তিনি আনমনে বলেছিলেন, ‘আমারও দেশেরও মাটির গন্ধে/ ভরে আছে এই মন, শ্যামল কোমল পরশ ছড়ায়ে/ নেই কিছু প্রয়োজন।’

পৃথিবীর সব দেশে সব কালে দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রমাণ হলো, নিজের জীবনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান—বীরশ্রেষ্ঠ নামে তাঁরা আমাদের ইতিহাসের অহংকার। আর যাঁরা জীবন উৎসর্গের শপথ নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছেন, তাঁরা বীর উত্তম। জিয়াউর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অলংকৃত বীর উত্তম। এই অর্জন, এই উপাধি কারো দয়ার দান নয়। তিনি যুদ্ধ করেছেন সেক্টর থেকে সেক্টরে। সীমান্ত থেকে সীমান্তে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও ময়মনসিংহের খাল-নদী-বিলে অথবা পাহাড়ে। তাঁর নামে ‘জেড ফোর্স’ অভিধায় পরিচিত হয়েছে মুক্তিসেনারা। 

যুদ্ধ অবশেষে যখন তিনি দেশে এলেন বীরের বেশে, তখন তিনি পাননি রাষ্ট্রের যথার্থ পদাধিকার। কিন্তু তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে অবনত চিত্তে মেনে নিয়েছেন রাষ্ট্রের আদেশ। তিনি কোনো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অথবা ষড়যন্ত্রে অথবা রক্তপাতে নিজের নাম সম্পৃক্ত করেননি। তবে যে দেশ ও জাতির নামে তিনি মুক্তির শপথ নিয়েছিলেন, তার সংকট সময়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেননি। যথাযথ দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। দেশপ্রেমের নাম যদি হয় ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, কেবলই দেশের স্বার্থ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব—তিনি সে ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। তাই দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্বে সমর্পিত হতে। 

দেশপ্রেম যদি হয় দেশ গড়া, নিরন্ন মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাহলে জিয়াউর রহমান সত্যিই দেশকে ভালোবেসেছিলেন অকাতরে। গ্রামের মানুষের প্রতি অসীম দরদে তিনি হেঁটেছেন বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, গ্রামগঞ্জে এবং প্রান্তিক সমাজে। তিনি দেখেছেন জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে। আবিষ্কার করেছেন নজরুলের বাংলাদেশকে। ফিরে পেতে চেয়েছেন সোনার বাংলা হারানো ঐতিহ্যকে। ইতিহাসকার বলেন, তিনি বাংলাকে দেখেছেন হক সাহেব বা শেখ সাহেবের চেয়ে বেশি করে। সকাল-সন্ধ্যা সারা দিন সারা রাত তাঁর সময় কেটেছে আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে দেখে। এটা কোনো প্রশংসিত নয়। যাঁরা দেখেছেন ’৭৫-৮১ সময়কালকে তারা সাক্ষ্য দিচ্ছেন এসব অনায়াসে। দেশপ্রেম যদি হয় দেশের মানুষের হৃদয়ের খবর রাখা, তাহলে তিনি ছিলেন গণমানুষের মনের রাজা। তাই তিনি এনেছেন সংবিধানে এমন কিছু যা লালিত ছিল, মানুষের মনের সংগোপনে। দেশপ্রেমের অর্থ যদি হয় দেশকে স্বাবলম্বী করা, তাহলে যথার্থভাবেই তিনি কেটেছিলেন খাল, দ্বিগুণ করতে চেয়েছেন সোনালি ফসল এবং গাঁও-গ্রামের চাষাভুষার জীবনের জয়গান গেয়েছেন। 

দেশকে ভালোবাসা মানেই মানুষকে ভালোবাসা। জিয়াউর রহমান যে সময় দায়িত্ব নিয়েছিলেন দেশের, তখন জনগণের শাসনের দাবি, গণতন্ত্রের আহ্বান তীব্রতর ছিল না। তুষ্ট ছিল সকলে তার সুশাসনে। মজলুম জননেতা আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘যুগ যুগ থেকো তুমি।’ কিন্তু তিনি সকলের মাঝে বাঁচতে চাইলেন। সকলকে নিয়ে দেশ গড়তে চাইলেন। তাই অনুষ্ঠিত হলো গণভোট, রাষ্ট্রপতি এবং সংসদীয় নির্বাচন। তিনি চাইলেন রাজনীতিকে গণমানুষের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউস রক্তে প্লাবিত হয় জিয়াউর রহমানের তাজা রক্তে। ঘাতকের বুলেট বিদীর্ণ হয় তাঁর দেহ। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি লিখে গেলেন দেশপ্রেমের ইতিহাস। এডউইন আর্নলন্ডের মতো হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘জীবনকে ভালোবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।’ সে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর কাফন ছুয়ে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, জিয়া আছে মিশে সারা বাংলায় সবুজ ধানের শীষে। 

দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য যে রাজনীতিকে আপ্লুত করেছিলেন জিয়াউর রহমান দেশপ্রেমের আবেশে, সততা, স্বচ্ছতা এবং নিরাভরণ জীবন দিয়ে আজ তা অলীক কল্পনা। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলে গেছেন, ‘দেশ আজ বাজিকরের হাতে। সে দেশকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে আজ একজন জিয়াউর রহমানের উত্থান বড় প্রয়োজন। ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’ তা যদি সত্যি হয়, তাহলে জিয়ার সৈনিকদের সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। জিয়াউর রহমানের রক্তঋণ আমাদের উদ্দীপ্ত করুক নতুন শপথে, গণতন্ত্রের লক্ষ্যে। শহীদ জিয়ার আদর্শ আমাদের এগিয়ে দিবে নতুন সূর্যোদয়ের পথে। 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।