অভিমত

প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন সরকারের

Looks like you've blocked notifications!

গত ১ জুনের প্রস্তাবিত বাজেটের স্লোগান ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’। যদিও নামে কিছু এসে যায় না, কাজই আসল। তারপরও একটি সুন্দর শিরোনাম অনেক অর্থ বহন করে। এবারের স্লোগান নিয়ে আমার দুটো প্রশ্ন : প্রথমটি দেশ এখন উন্নয়নের নাকি প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে? দ্বিতীয়টি সময় এখন কার - সরকারের নাকি জনগণের? প্রথমত অর্থনীতিতে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি এক নয়। আজকের বাংলাদেশ যা দেখছে তা হচ্ছে প্রবৃদ্ধি - উন্নয়ন নয়। আমি বিষয়টির তাত্ত্বিক গভীরে না গেলেও গত বছরের বাজেটের শিরোনাম উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। গত বছরের বাজেটের শিরোনাম ছিল ‘প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রযাত্রা’। এটা থেকে প্রতীয়মান হয় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন এক নয়। আরো মজার ব্যাপার হলো, অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধি বৈষম্য প্রভৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে শুধু উন্নয়ন নিয়ে মেতেছেন। ঠিক যেমন তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধি সমতা সবকিছু পেরিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে একপায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। মহাসড়কে চলতে গেলে যেমন ভালো গাড়ি দরকার, তেমনি দরকার পাকা ড্রাইভার; সঙ্গে গতি তদারকির সুদক্ষ ব্যবস্থা। তা না হলে যাত্রীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় - সংবাদপত্র খুললেই সেটা বুঝতে বেশি জ্ঞানবুদ্ধির দরকার হয় না। দ্বিতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে আমি অর্থমন্ত্রীর কাছে সবিনয়ে জানতে চাই— সময় এখন কার? আজকের বাস্তবতায় সরকার নামক অনুমোদনহীন গাড়িতে চড়ে নিয়ন্ত্রণহীন মহাসড়কে জনগণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে, যার মূল উৎস সুশাসনের অভাব। ভোক্তা আমানতকারী সবাই আছেন আতঙ্কে। সেই আতঙ্কের জায়গাটি তৈরি হয়েছে যে দুটো বিষয় নিয়ে তা হচ্ছে ভ্যাট আর আবগারি শুল্ক। তাই এবারের বাজেটের স্লোগান ‘প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন সরকারের’ হওয়াটা সমীচীন।

এবারের বাজেটটি যে কারণে বেশি আলোচিত এবং একই সঙ্গে বিতর্কের সূচনা করেছে, তা হচ্ছে ভ্যাট আর আবগারি শুল্ক। আবগারি নয়, এ যেন আত্মঘাতী শুল্ক। ব্যাংক থেকে অর্জিত মুনাফার ওপর কর আরোপ করলে সেটা যৌক্তিক হতে পারে কিন্তু সরাসরি সঞ্চয়ের ওপর কর আরোপ যার ওপর পূর্বেই যদি আয়কর প্রদান করা হয়ে থাকে তবে সেটা হবে অনৈতিক ও অযৌক্তিক। এটা একরকম দস্যুতা। ভঙ্গুর আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থা এমনিতেই তলানিতে, তার ওপর আবার এই আবগারি শুল্ক মানুষকে একেবারেই ব্যাংকবিমুখ করতে পারে - এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যেমন নেমে আসবে চরম দুর্দশা, তেমনি বিনিয়োগে পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্সপ্রবাহ নিরুসাহিত হতে পারে। তা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত অর্থ পাচারসহ কালো টাকার বাজারকে উৎসাহিত করবে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো দেশে এমন নজির আছে কি না, আমি খুঁজে পাইনি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যাদের এক লাখ টাকার ওপর আমানত আছে সে সম্পদশালী। একজন গৃহকর্মী ১২ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে তিল তিল করে দেড় লাখ টাকা ব্যাংকে জমিয়েছেন মেয়ের বিয়ের উদ্দেশ্যে। মন্ত্রীর ভাষ্যে উনি সম্পদশালী।

প্রস্তাবিত বাজেটে আরেকটি আতঙ্কের নাম মূল্য সংযোজন কর যা ভ্যাট নামেই বেশি সুবিদিত। এটি একটি পরোক্ষ কর যা দ্রব্য ও সেবা সামগ্রীর দেশের অভ্যন্তরে ভোগের ওপর আরোপিত হয়। এই করে সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো এটি একটি পশ্চাদমুখী কর। গবেষণায় দেখা যায় এখানে ধনিকশ্রেণির চেয়ে দরিদ্র শ্রেণির আয়ের বেশি অংশ ভ্যাট দিতে হয় - মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। তা ছাড়া অর্থনীতি বলে অর্থের প্রান্তিক উপযোগ ধনী ও দরিদ্রের কাছে সমান নয়- প্রতি ১০০ টাকায় ভ্যাটের ১৫ টাকা ব্যয় একজন রিকশাচালকের কাছে আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে সমান পীড়াদায়ক নয়। ভ্যাটের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি ও আয় বৈষম্য অন্যতম। উচ্চ ভ্যাট হার দ্রব্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি করবে যার ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেন না তাদের আয়ের বেশির ভাগ অংশ ব্যয় করে ভোগ্যপণ্যের ওপর। এছাড়া কর আয়ের একটি অংশ যাচ্ছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর মূলধন সহায়তা বাবদ যার ফলভোগ করছে উচ্চ আয়ের কিছু মানুষ। ফলশ্রুতিতে সমাজে আয় বৈষম্য আরো প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। সরকারের যে দরিদ্রবান্ধব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য তা থেকে বিচ্যুত হতে পারে। সরকারের উচিত সম্ভাব্য এই সব পরিণতি আরো মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করা। পুঁজিবাদে বড় পুঁজি যখন ঠিকঠাক কাজ করে না, আমরা দেখেছি নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস কীভাবে বড় পুঁজি ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সেখান থেকে মুনাফা অর্জন করছে। ঠিক তেমনি এই সরকার যখন আয় কর কিংবা করপোরেট কর আদায়ের ক্ষেত্রে বড় রুই-কাতলাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না, তখনই ভ্যাটের মাধ্যমে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে কীভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায় সে কৌশলে লিপ্ত। দেশের মানুষ যেখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, সেই বাস্তবতায় গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের পকেট কাটার এই ভ্যাট-ট্যাক্স কৌশল থেকে সরকারের সরে আসা সমীচীন। 

নিঃসন্দেহে সরকারের এই কর সংস্কার অনেক বড় একটি এজেন্ডা। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে আরো গভীর পর্যালোচনা বা সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময়ের অবকাশ রাখে।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে ভ্যাটের আবশ্যকতা কি; অর্থনৈতিকভাবে এটা কত ভালোভাবে সমর্থনযোগ্য; সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব; শক্ত অর্থনৈতিক মডেল দ্বারা এটি সমর্থিত কি না; বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা সর্বোত্তম উপায় বা পছন্দ কি না; আয় বাড়ানোর অন্য কোনো উপায় আছে কি না সেগুলো ভ্যাটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আরো গভীর ও নিবিড়ভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। এটা সত্য যে একটা বড় ঘাটতির বাজেটে আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই তবে তা সার্বিক কল্যাণ প্রশ্নবিদ্ধ করে নয়।

প্রস্তাবিত বাজেটের আর একটা লক্ষণীয় দিক হলো, এটি একটি বড় ঘাটতির বড় বাজেট। অর্থমন্ত্রী নিজে বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেট একটি উচ্চাভিলাষী বাজেট। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ২৬ শতাংশ বড় যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের মোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে ৭.২৪ শতাংশ। বাজেটের এই উচ্চলম্ফনকে উচ্চাভিলাষী বললে হয়তো কমই বলা হয়। একইভাবে বড় বাজেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ বছরেও প্রস্তাবিত বাজেটে একটি বড় অঙ্কের বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ মোট বাজেটের  এক-চতুর্থাংশের বেশি এবং জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল জিডিপির ৩.৮ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩.৮ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ সম্পূরক বাজেটে তা দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে। ক্রমবর্ধমান এই বাজেট ঘাটতি শঙ্কা না সম্ভাবনা এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনার অবকাশ রাখে। প্রথমত, এই ঘাটতি আরো বাড়বে যদি রাজস্ব আয়ের প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হয়। আগের অভিজ্ঞতা হলো এই যে আজ অবধি কোনো সরকারই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেননি। যেখানে রাজস্ব আয় আশানুরূপ না হওয়ায় সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব আয় ২,১৮,৫০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে; সেখানে বর্তমান বাজেটে ২,৮৭,৯৯১ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার কোটি অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা সক্ষমতার নিরিখে কতটুকু যৌক্তিক সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, ঘাটতির একটি বড় অংশ বৈদেশিক অনুদাননির্ভর কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই উৎস থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থ পাচ্ছে না।

ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে ২০১৬-১৭ বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ এবং ২০১৫-১৬ বাজেটের প্রায় চারগুণ বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ মোটেও বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়। তৃতীয়ত, সরকার যেখানে ব্যাংকগুলোকে পুঁজি সহায়তা দিয়ে জিইয়ে রাখছে, সেই তাদের কাছ থেকে কীভাবে আবার ঋণ নিয়ে বাজেটের ব্যয় মেটাবেন সেটি খুব বেশি বোধগম্য হয় না। সব মিলিয়ে বাজেটে ব্যয় ঠিক থাকলে বাজেট ঘাটতি সুনিচ্চিতভাবে আরো বেড়ে যাবে, যা আগামী দিনগুলোতে উন্নয়ন খাতের ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর একটি বড় ও দীর্ঘমেয়াদি দায় সৃষ্টি হবে।

আগামী দিনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিনিয়োগ একটি দেশের উন্নয়নের ভিত রচনা করে। কিন্তু ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে একটি জায়গায় আটকে আছে টাকার অঙ্কে যা জিডিপির প্রায় ২৩ শতাংশ। বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ কোনো দিকনির্দেশনা বা প্রণোদনার কথা এই বাজেটে নেই। একইভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়েও নেই কোনো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না- এটা উদ্বিগ্নের। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বাংলাদেশে তাহলে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কি না যেমনটি প্রশ্ন উঠছে সুশাসন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব কি না। অর্থনীতিবিদ আর্থার ওকান জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি ধনাত্মক পরিসংখ্যানিক সম্পর্ক দেখিয়েছেন; যা ওকানস ল নামে পরিচিত। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন প্রতি ১ শতাংশ বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কমপক্ষে ২ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না- এখানে প্রবৃদ্ধি হলেও বেকারত্ব কমছে না। উন্নয়নের মহাসড়কে চলতে গেলে নাজুক বিনিয়োগ কাঠামো আর কর্মসংস্থানের দৈন্যতা স্পিডব্রেকার হয়ে অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে পারে। চলতি বাজেটে এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে আরো আন্তরিকতার সঙ্গে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।  

সরকারের ভাষ্যে দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। এই বাজেটটি হয়তো সেই সড়কে যাত্রার জ্বালানি হতে পারে। তবে যাত্রা শুরু করার আগে সরকারের উচিত সড়কটা ভালোভাবে চিনে নিতে, গাড়িটির সঠিক অনুমোদন আছে কি না দেখে নিতে, গতিসীমা জেনে নিতে তা না হলে দুর্ঘটনায় পড়ে এতদিনের অর্জন মলিন হয়ে যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতা কবি রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করেছেন, ‘আমাদের যেতে হবে বহুদূর’। ওনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারকে বলব আমরা বীর জাতি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যের পথ বেয়ে দেশপ্রেমের আদর্শ বুকে ধারণ করে সমৃদ্ধির পথে যেতে চাই বহুদূর, তবে আর একা নয় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে নতুবা গানের কথায়, ‘...চলেছো একেলা কোথায়? পথ খুঁজে পাবে না তো গেছো একা’।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়