কথাসাহিত্যিকের চোখে

গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জনগণ

Looks like you've blocked notifications!

গত সাড়ে চার দশকে এত রকম কাটছাঁট হওয়ার পরও আমাদের সংবিধানের যা অবশিষ্ট আছে তা মেনে চলার জন্য, সে অনুযায়ী দেশ চালানোর জন্য একটির পর একটি সরকার আসছে। আমি বলছি, গণতান্ত্রিক উপায়েই হোক, আধা-গণতান্ত্রিক উপায়েই হোক আর সম্পূর্ণ সামরিক কায়দাতেই হোক, সব রকমের অভিজ্ঞতাই আমাদের আছে। পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সেনা অভ্যুত্থান হয়, নব্বই সাল পর্যন্ত তা চলে। নব্বই সালের আগ পর্যন্ত যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ঐক্যও আমরা দেখেছি এবং শেষ পর্যন্ত আন্দোলন সফল হওয়ার ফলে নব্বই সাল থেকে আবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো, তা-ও দেখলাম। ক্ষমতায় আসে একটির পর একটি রাজনীতিক দল। 

সাড়ে চার দশক পরে আমাদের মনে হয়, ১৯৭১ সালে যে সংবিধান, পরবর্তী সময়ে তাতে যে সংযোজন হয়েছে, সংশোধন হয়েছে তারপরও যা আছে তা আজ আমরা সম্পূর্ণ মান্য করে চলছি? দেশটা কি গণতান্ত্রিক করা গেছে? সে জন্য যে উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল, সেটা কি পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়েছে? গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পৃথিবীর নানান দেশেই অনুসৃত হচ্ছে। আমার নিজের মত হচ্ছে, গণতন্ত্র বহুরূপী। একেকটি গণতান্ত্রিক দেশ একেক রকমের। গণতন্ত্রের নামে সম্পূর্ণ স্বৈরশাসনও সম্ভব হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ নাকি গণতন্ত্রের অনুকরণীয় স্থল। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক যে সাম্রাজ্যবাদ, যা গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, তার সঙ্গে গণতন্ত্র তো যায় না। কারণ, আমার রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে গণতন্ত্র পালন করব আর অন্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করব, এটাকে গণতন্ত্র বলা চলে না। 

আজ বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, শোষণমূলক একটা বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন। কে কাকে গ্রাস করবে? এর নাম মাৎসন্যায়, অর্থাৎ বড় মাছ ছোট মাছকে খাবে। এই যে অবস্থা পৃথিবীর দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের দেশকেও আক্রমণ করছে। আমাদের এখানেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত বিনষ্ট হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের কথা ছেড়ে দিলাম, গণতন্ত্রেই তা সংশোধন করে বলা হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার। কথাটা এতই অস্পষ্ট যে, সামাজিক ন্যায়বিচারের নামে গ্রামে গ্রামে তথাকথিত মুরব্বিরা নানান ধরনের সামাজিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে, তার চাইতে বেআইনি কাজ তো আর কিছু হতে পারে না। 

যাই হোক, গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রগতি কতটা হয়েছে? লোকে বলতে পারে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র তো এখন চলছে। নব্বই থেকে পঁচানব্বই পর্যন্ত যে গণতন্ত্র ছিল, তা কণ্ঠরোধকারী গণতন্ত্র। পঁচানব্বইয়ের পরে দেশে একধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; অনেক পুরোনো দল, পাঁচের দশকের আগে থেকে যাদের রাজনীতি, সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, তবে বিশেষ কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। আবার বিরোধী দলের যে বিরোধিতা, সেটাও গণতান্ত্রিক বিরোধিতা নয়। 
এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতাটা গ্রহণ করল নিজের হাতে এবং গায়ের জোরেই তা করল। তারপর নির্বাচনে একদল বিজয়ী হলো। কিন্তু পরের নির্বাচনে বিরোধীদল অংশগ্রহণ করল না এবং যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, ভাবলেন, আর উপায় কী? গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলে নির্বাচন ডাকা হয়েছে, নির্বাচনে এলো না; তাহলে শাসন ক্ষমতায় যারা ছিল, তাদের সরকারই বহাল থাকবে। জানি না, এটাই বিকল্প ছিল কি না। নির্বাচন ঠিকভাবে হলো না; ঠিক আছে, অল্প সময় ক্ষমতায় থেকে আবার নির্বাচন দেওয়া যেত।

যে উপলক্ষে রাজনীতি, সেই সমাজ ও সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ, তাদের অবস্থার কি ১৯৭১ সালের পর এই ৪৫ বছরে মৌলিকভাবে পরিবর্তন হয়েছে? বাংলাদেশ এখনো কৃষিনির্ভর দেশ, এখানে বৃহৎ শিল্পের তেমন কোনো বিকাশ হয়নি। পোশাকশিল্পের যে বড় ব্যবসা গড়ে উঠেছে এখানে, এটাকে শিল্প বলা যায় না। অসংখ্য মানুষ কাজ করছে, আসলে সস্তায় শ্রম শোষণ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য ধনী দেশ সস্তা শ্রমটা কিনছে। ফলে মৌলিকভাবে মানুষের দুঃখ দূর হওয়া বা দারিদ্র্যের স্থায়ী নিরসন সম্ভব হয়নি। অবাধ ভোটাধিকার শেষ পর্যন্ত কথার কথা থেকে গেছে। হাত-পা বাঁধা স্বাধীনতা কি সত্যি স্বাধীনতা? 

বিদেশের দেশগুলো তো আছেই, সেখানকার সাধারণ মানুষের যে স্বাধীনতা ভোগ করে সেটার সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে আমাদের এখানে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা সমস্ত ক্ষেত্রেই মর্মান্তিক দুরবস্থা রয়েছে। যদি বলি যে অন্ন এখন সকলেরই জুটছে সেটাই কি যথেষ্ট? অন্নের সঙ্গে কি অন্যান্য জিনিসের দরকার নেই? দুই বেলা শুধু ভাত খেলেই কি হবে? বা দুই বেলা শাকসবজি, ভাত খাই তাতে-ই কি হবে? শরীরের অন্যান্য পুষ্টির দরকার নেই?

বাংলাদেশের নানা রকম পরিসংখ্যানবিদগণ এসবের হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করেন না। একসময় বলা হতো, ৮০ ভাগ শিশু প্রাথমিক স্তরে এসেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। এখন বলা হচ্ছে—না থাকে, ৮০ ভাগ থাকে। আবার আরেকটা ভাগ এখন করা হয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কেন এই ভাগ জানি না, তাতে কী সুবিধা হয়েছে বলতে পারব না। ওই ডিগ্রি দিয়ে কোনো লাভ হয়? অষ্টম শ্রেণির ডিগ্রি দিয়ে কেউ কাজ পায় বা বলতে পারে অষ্টম শ্রেণির ডিগ্রি আমার আছে কাজ দিতে হবে? কাজেই যা হচ্ছে, সব বাইরের দিক থেকে। কিন্তু ভেতরটা যদি ফোঁপড়া হয়, তাহলে ওপরে একেবারে যথাযথ দেখালেও, অক্ষত এবং সুন্দর দেখালেও কোনো একটা চাপ আসলেই তা মড়মড় করে ভেঙে পড়বে। 

আমাদের এখানে গণশিক্ষা, কল্যাণমুখী শিক্ষা—এ রকম বুলি প্রচুর আওড়াই, কিন্তু ভেবে দেখি না, প্রাথমিক শেষ হওয়ার আগে, মানে প্রাথমিক অষ্টম শ্রেণি ধরেই নিচ্ছি, তার পরবর্তী ধাপে কতজন ঝরে পড়ে। তারপর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরে কতজন আর পড়ার সুযোগ পায় না, ওপরে যেতে পারে না। এইচএসসিতে যারা যায়, তাদের কত শতাংশ ঝরে পরে, কতজনই বা অনার্সে ভর্তি হতে পারে? আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি ছেড়ে দিচ্ছি, দু-চারটা বাদ দিয়ে ওদের শিক্ষাকে শিক্ষা বলে মেনে নেওয়া কঠিন। এ ছাড়া অন্য যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে কী মানের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, কত শিক্ষার্থী সেখানে যাচ্ছে, সেটাও দেখা দরকার। 

সর্বোচ্চ পরীক্ষা, অর্থাৎ অনার্স এবং মাস্টার্স—এ দুটির পরে, যদি প্রাথমিকের সঙ্গে তুলনা করা হয় কত শতাংশ ঝরে পড়েছিল, তখন কী দেখা যাবে? সে হিসাব কি কেউ কখন দিয়েছে? তাহলে মাঝখানে এরা গেল কোথায়? এরা কি কাজ পেয়েছিল? উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীদের কি কাজ মেলে? রাষ্ট্রে কি তাদের জন্য কাজ আছে? সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেলেও সবাই কি কাজ পায়? তাহলে এখন বি কম, এম কম এসবের কেন এত দাপট? বলা হচ্ছে পৃথিবীটা এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক, বাণিজ্য-সংক্রান্ত লেখাপড়া করলে নাকি কাজ পাওয়া যায়। বাকি সবই বৃথা? মানবিক যে উন্নয়ন, মানুষের ভেতরের প্রবৃত্তিগুলোর যে উন্নয়ন, মানুষ নিজেই যে একটা ধাপ থেকে আরেকটা ধাপে উঠে পড়বে, সাংস্কৃতিক-রাজনীতিকভাবে, সমস্ত দিক থেকে, এগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি কি?

আমি যখন উন্নয়নের কথা বলতে যাই, তখন আমার কথা অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায় এসব কারণেই। অন্যেরা পরিসংখ্যান দেন—এত রাস্তা হয়েছে, এত সেতু হয়েছে—হ্যাঁ, এগুলোতে জনগণের উপকার হবে, তবে খুবই প্রান্তিক। সেতু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, এর সঙ্গে যারা যুক্ত আছে, তাদের সুবিধা বাড়বে। পরিবহনের সঙ্গে যারা যুক্ত আছে, তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। কাজেই সেতু হওয়া ভালো, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু যখন বলা হয়, জনগণের জন্য হচ্ছে, এই কথাটা মেনে নিতে আমার মন সায় দেয় না।    

সাধারণভাবে আমার মনে হয়, ১৯৭১-এর পরে ২০১৭ সালের যে বিশ্ব এবং সেই বিশ্বে বাংলাদেশের যে অবস্থান, সেখানে বুক ফুলিয়ে গর্ব করার মতো—মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা অন্দোলন—অনেক গৌরবের শৃঙ্গ আমাদের আছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু শৃঙ্গের নিচে যে খাদগুলো আছে, সেগুলো অতল হয়ে রয়েছে। সেগুলোতে একবার পড়লে নিচে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সার্বিকভাবে আমি বাংলাদেশকে যে জায়গায় দেখতে চাই, সেখানে দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হয় না।

আমাদের যে আস্থাটুকু বর্তমান শাসকদের ওপর আছে, তা ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। দেশে কত কৃষি জমি? অনুপস্থিত ভূস্বামী কত আছে। যাদের জমি আছে কিন্তু নিজেরা জমিতে যান না, তাদের ভাগচাষি আছে। ভাগচাষিদের কপালে কী জোটে? উৎপাদিত ফসল নাকি আমাদের জন্য যথেষ্ট। উৎপাদিত হয়ে যাওয়ার পরে এই ফসল কার কাছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে, আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি না। গম আসে, কেন আসে, কতটা আসে, আমরা জানতে পারি না। এসব জায়গায় দুর্নীতি কতদূর সর্বনাশ করছে সাধারণ মানুষের, তার পরিসংখ্যান কোথায়? 

আত্মসন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে দেশ এগোবে না। আত্মসন্তুষ্ট হয়ে বসে আছি, আমি বসে আছি, আমার মতো মধ্যবিত্ত বসে আছে, উচ্চবিত্ত বসে আছে, ধনশালীরা বসে আছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা তো ১০ থেকে ১৫ ভাগের বেশি না। বাকিরা তো এদের মধ্যে আসছে না, তাহলে তাদের জন্য চিন্তাই বা করবে কে, বলবেই বা কে? জনগণের কথা কেউ শোনেও না, শোনার কোনো উপায়ও নেই। কারণ, কোনো একটা মাঠে বা কোনো একটা জায়গায় দেশের ১৬ কোটি মানুষ একসঙ্গে এক কথা বলতে পারে, এমন তো কোনো ব্যবস্থা নেই। পৃথিবীতে কোথাও নেই। কাজেই ভোট-সান্ত্বনা নিয়ে গণতন্ত্রের কথা বোঝাতে হয়। 
(শ্রুতিলিখিত)

হাসান আজিজুল হক : কথাসাহিত্যিক