প্রতিক্রিয়া
আমরা পাহারাদার, আপনি ঘুমান মহারাজ!
ঠিক বুঝতে পারছি না কী বললে আমাদের, মানে এ দেশের সাধারণ মানুষের একটা বেশ বড় অংশকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে। ‘পাহারাদার’ কথাটিই সবচেয়ে মানানসই লাগছে। হ্যাঁ, আমরা এখন এক একটা পাহারাদার হয়ে উঠেছি বা উঠতে হচ্ছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম। সাংবাদিকরা একেকজন ওয়াচডগ। কোথাও কোনো অনর্থ আর অনিয়ম বা অন্যায় হচ্ছে, তা পাহারা দিয়ে রাখা আর প্রয়োজনে সেটা জানান দেওয়া, সতর্ক করাই তাদের কাজ। এখন দেশের যা পরিস্থিতি, বিবেকবান প্রতিটা নাগরিককেই হয়ে উঠতে হচ্ছে সেই ওয়াচডগ। পুলিশ নামের যে বাহিনীটাকে সরকার আমাদের ট্যাক্সের টাকায় পেলেপুষে তেলতেলে বানাচ্ছে, তারা ঘুষ খাবে আর অপরাধীকে কিচ্ছু না করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেবে, এই তো আমাদের নিয়তি। তাই আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছি যতটা পারা যায় তাদের বাধ্য করা অপরাধীকে ধরতে এবং এখন ওয়াশিকুর বাবুর হত্যাকারী থেকে শুরু করে রাজনের খুনিকে ধরতেও তাই আমাদেরকেই প্রয়োজন হচ্ছে। রাজনের খুনি কামরুল যখন সৌদিতে পালাচ্ছিল, পুলিশ তখন গ্রীষ্মের আম খেয়ে ঘুমাচ্ছিল ঘরে। তাই আর কী করা! আমরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় চেঁচামেচি করে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাড়াটা দিলাম। খুনি ধরা পড়ল। ওয়াশিকুরের খুনিকে হাতেনাতে ধরে দিয়েছিলেন দুজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। অদূরে দাঁড়িয়ে পুলিশ কী করছিল, তা আজো আমরা জানি না। জানবও না কখনো।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এই পোড়া দেশে এত এত মারাত্মক জাতীয় সমস্যার ভিড়ে এবং একইসাথে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনযন্ত্রণা সামাল দিতে দিতে আমরা একেকটা ঘটনা দীর্ঘদিন ফলোআপ চালিয়ে যেতে পারছি না। আর সেটাই স্বাভাবিক। ফলোআপ করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। বরং অপরাধী ধরা পড়ার পর রাষ্ট্র তার যথাযথ বিচার করবে, এটা জেনে আমাদের নিশ্চিত হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু এই বঙ্গদেশে জন্মে এই অসম্ভব আশা করা যে নিতান্তই দুরাশা, তা এত দিনে আমরা সবাই বুঝে গেছি।
ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। একেকটা বড় বড় ঘটনা, মারাত্মক সব অপরাধ চাপা পড়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার স্তরের নিচে। এই কুয়াশা আর এ জন্মে কাটবে, আমি তা বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছি। এই ঘনঘোর অন্ধকার কুয়াশার তলে চাপা পড়েছে সাগর-রুনি, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, রাজীব হায়দার, অনন্ত, মিলনসহ আরো অন্তত কয়েক ডজন নাম। এই তালিকায় হয়তো যুক্ত হবে রাজনের নামটিও। ধর্ষণের মারাত্মক ঘটনাগুলোও চাপা পড়ে যাচ্ছে। ধর্ষক ধরা পড়ছে। রিমান্ড হচ্ছে। তারপর কী হচ্ছে? তারপর আমরা ভাপা পিঠা খেতে খেতে, গরম চা গিলতে গিলতে, শহরের চিপা রাস্তায় প্রবল যানজটের মধ্যে গা বাঁচিয়ে সামনে এগোতে এগোতে যেই দেখছি বাড়ির দরজা সামনে, অমনি সুরুৎ করে ঢুকে পড়ছি ভিতরে। আহ! আরাম। আর করবই বা কী? আমার যা পেশা, তা আমি মাটি কাটি আর ইট ভাঙ্গি, শিক্ষক হই বা ছাত্র, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী বা গৃহিণী, আমাকে তো ২৪ ঘণ্টায় সেই কাজটা ঠিকমত করে দুবেলার ভাগ জোগার করতে হচ্ছে। ফলে ফলোআপের কথা একসময় ভুলছি। আর প্রতিদিনই তো নিত্যনতুন ঘটছে। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলে চেঁচাবো। এই গারো তরুণিকে তুলে নিয়ে গেল। এইতো অভিজিৎকে কুপিয়ে টুকরো করল। এ এক বিষম জ্বালা! প্রতি মুহূর্তে নিজের আর প্রিয়জনের জান-মান নিয়েও তো ভাবতে হচ্ছে। কোনটা রেখে কোনটা করি। সোশ্যাল ওয়ার্ক কি সারাক্ষণ পোষায়?
এই কাজটা করার কথা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, প্রশাসনের, সর্বোপরি সরকারের। তাহলে তারা করছেটা কী? রক্তঘাম এক করা ট্যাক্সের টাকায় যে সরকার পুষছি, যে পুলিশ আর প্রশাসন পালছি, তারা করছে টা কী? এর কোনো সদুত্তর নাই যুগের পর যুগ ধরে। ফলে, বহু ঘটনারই ন্যায্য বিচার পাব না, এটাই ধরে নিয়েছি আমরা। কিন্তু, ওই যে বিবেক বলে একটা ফালতু জিনিস এখনো আমাদের কারো কারো বুকের ভেতরে ক্যান্সারের মত বাসা বেঁধে আছে, ওই রোগের যন্ত্রণাতেই আমরা চেচাচ্ছি, রাগছি, চিৎকার করছি, কাঁদছি আর কষ্টে বেদনা মুষড়ে পড়ছি। তাতে অবশ্য ওই বাহিনী, প্রশাসন আর সরকারের কী হচ্ছে? কী হচ্ছে, একমাত্র কদর্য ভাষা ছাড়া তা প্রকাশ করার আর কোনো উপায় আমার জানা নাই।
এ দেশের সাংবাদিকরা কিন্তু বসে নেই। বেতন পান না, ছুটি পান না, গরিব সাংবাদিকের দল কিন্তু লেগে আছে ঘটনার পেছনে। কিন্তু তাঁদের অবস্থাও সমুদ্রে ভাসমান তেলাপোকার মতো আজ। কত ঢেউ সামলাবেন? আর ক্ষমতাবানদের হম্বিতম্বি তো আছেই। ফলে যা হওয়ার তাই। বিচারহীনতাই আজ এ দেশের সংস্কৃতি। এর থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে আসার কোনো আশা আর করি না। জানি না সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করে আছে! কোন নরকদৃশ্য দেখতে হবে চোখের সামনে! জানিনা ‘উদ্ভট উটের পিঠে’ চেপে কোথায় কোন মহানরকের দিকে চলেছে আমার স্বদেশ!
লেখক : সাংবাদিক