‘চিনতে নাকি সোনার ছেলে ক্ষুদিরামকে?’

Looks like you've blocked notifications!

‘চিনতে নাকি সোনার ছেলে

ক্ষুদিরামকে চিনতে?

রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিল যে

মুক্ত বাতাস কিনতে?’

 

কখনো কখনো কিছু বিষয় ভাবতে অবাক লাগে! যে দেশে একদল যুবক বিশ্বজিৎ নামের একটি নিরীহ তরুণকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারেন, যে দেশে একদল তরুণ হলি আর্টিজানের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারেন, যে দেশে ১৪-১৫ বছরের একটি কিশোর ধর্ষক হতে পারে—সেই দেশেই কি ক্ষুদিরামের জন্ম হয়েছিল? ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে! আর সে কারণেই মনে হয়, আজ থেকে ১০৯ বছর আগে মুক্ত বাতাস, মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কিশোর হাসিমুখে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিয়েছিল—সেই অগ্নিকিশোর ক্ষুদিরামকে আমরা ভুলে গছি, তাঁকে আমরা চিনি না।

এ প্রজন্মের অনেকের কাছে অচেনা ক্ষুদিরাম ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাঁর ১০৯তম ফাঁসি দিবস আজ ১১ আগস্ট।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এই অগ্নিকিশোর ক্ষুদিরাম মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশের জন্য হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি পরেছিলেন। তাঁর সেই আত্মদান আজও কোটি মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। আজও মানুষ অবাক বিস্ময়ে ক্ষুদিরামের প্রবল দেশপ্রেমের কথা ভাবে আর অনুপ্রেরণা পায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। দেশ-কাল, ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে ক্ষুদিরাম বিপ্লবের এক মূর্ত প্রতীক।

ক্ষুদিরামের জন্ম ১৮৮৯ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের মেদিনীপুরে। তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট।

বাবা ত্রৈলক্যনাথ বসু ও মা লক্ষ্মীপ্রিয় দেবীর তিন কন্যার পর চতুর্থ সন্তান ক্ষুদিরাম। এর আগে লক্ষ্মীপ্রিয় দেবীর দুই ছেলে সন্তান মারা যায়। প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে বড় বোন অপরূপার কাছে ক্ষুদিরামকে বিক্রি করে দেন মা। তাই তার নাম রাখা হয়েছিল ক্ষুদিরাম। ছয় বছর বয়সে ক্ষুদিরাম তাঁর মা-বাবাকে হারান।

১৯০৫ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার উদ্দেশ্যে বাংলাকে ভাগ করার উদ্যোগ নিলে স্বদেশি আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। হাটে-বাজারে বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বানসংবলিত লিফলেট বিলি ও প্রচার, কখনো কখনো বিদেশি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা বা দোকানে দোকানে পিকেটিং করা তখন স্বদেশিদের নিয়মিত কার্যক্রম। মাত্র ১২ বছর বয়সেই ক্ষুদিরাম বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ও রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে। তার পর হেমচন্দ্র কানুনগো ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সংস্পর্শে এসে তা আরো গতি পায়। ক্ষুদিরাম যোগ দেন বিপ্লবী রাজনৈতিক দল ‘যুগান্তর’-এ। ১৬ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম ইংরেজ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতে রাখেন। কয়েক দফা বোমা হামলার দায়ে ক্ষুদিরামকে আটক করা হয়।

কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট বড়লাট ডগলাস কিংসফোর্ড ছিলেন অত্যাচারী এক ইংরেজ প্রশাসক। এই বড়লাটকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর ওপর। ১৯০৮ সালে মুজাফফরপুরে ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়লে বড়লাটের বদলে অন্য তিন ইংরেজ মারা যায়।

এ ঘটনার পর প্রফুল্ল চাকী মোকামঘাটের দিকে পালিয়ে যান। পথে এক রেলস্টেশনে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে প্রফুল্ল চাকী সঙ্গে থাকা রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে ক্ষুদিরাম বসুকে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়। হত্যা ও বোমা হামলার দায়ে ক্ষুদিরামকে ফাঁসির আদেশ দেয় ইংরেজ সরকার। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর ৬টায় ক্ষুদিরামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। দেশের মানুষের মুক্তির সেই আকুতিকে বুকে ধারণ করেছিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর মতো বিপ্লবী কিছু কিশোর। জীবনের মতো অমূল্য সম্পদকে তুচ্ছজ্ঞান করে ওরা দেশের শত্রুদের তাড়িয়ে দিতে বন্ধুর পথ বেছে নিয়েছিল। তাদের সেই অসীম সাহসিকতা ইংরেজদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা ফাঁসিতে চড়িয়েছিল ক্ষুদিরামকে। ফাঁসির মঞ্চেও মাথা উঁচু করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিশোর ক্ষুদিরাম। ফাঁসির রায় শোনাবার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—কী তাঁর শেষ ইচ্ছা? ক্ষুদিরাম দৃঢকণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি দেশের মানুষকে বোমা বানানো শিখিয়ে যেতে চায়। এমন দুঃসাহসী উত্তরে ব্রিটিশদের বুক কেঁপে উঠেছিল।

জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়—ক্ষুদিরামের মৃত্যুতেই তার জ্বালিয়ে যাওয়া দেশপ্রেমের অগ্নিমশাল নিভে যায়নি; বরং দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল। সেই আগুন বুকে জ্বলে উঠেছিল বিনয়, বাদল, দীনেশ, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, আসফাকউল্লাহ, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, রামপ্রসাদ বিসমিল, সুভাষচন্দ্র বসুর মতো অসংখ্য নারী-পুরুষ। ক্ষুদিরামকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল কালজয়ী গান ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, যা এখনো মানুষের চোখে জল আনে।

ক্ষুদিরাম লড়াই করেছিল পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু দেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত মুক্তি মেলেনি আজো। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের মানুষ আজো নিজ নিজ দেশে দুঃশাসকদের অত্যাচারে স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাদ পায়নি।

সাম্প্রদায়িকতার ধারালো ছুরির আঘাতে গড়া লাশের পাহাড়ের ওপর ভাগ হওয়া দুটি রাষ্ট্রে একটি হলো পাকিস্তান। এই পাকিস্তানেও শুরু হলো অন্যায়-অত্যাচার। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর চালাতে লাগলো শোষণ-নির্যাতন। ধর্ম তাদের এক সুতোঁয় বেঁধে রাখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানিদের লাগামহীন শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ আবারও ধর্ম-বর্ণ নির্বিষেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জন্ম নিল বাংলাদেশ নামে আরেকটি রাষ্ট্র। দেশ স্বাধীন হলো।

দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্যি, কিন্তু দেশের মানুষ শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়নি। লুটপাট, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নানা ধরনের বৈষম্য, জঙ্গিবাদের উত্থান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, মাদকের বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার—সব মিলিয়ে দেশ এক সংকটময় সময় পার করছে। একসময় মুক্তচিন্তার লেখকদের ওপর নেমে এসেছিল চাপাতির কোপ, এখন নেমে আসছে ৫৭ ধারা। এই তো আমাদের মুক্ত স্বদেশ!

শুধু বাংলাদেশেই নয়, ক্ষুদিরামের অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভারত ও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এমনই ভয়াবহ দুঃসময় পার করছে। ভারতে বিজেপির মতো ধর্মান্ধ একটি দল শাসন ক্ষমতায়, যার প্রধানমন্ত্রীকে গুজরাটে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানে বছরের পর বছর চলছে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শাসন। আর দেশটিতে জঙ্গিবাদের বিস্তার পুরো বিশ্বেরই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদিরাম সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের হটাতে চেয়েছিল, এখন তাঁর নিজের দেশ ভারত সাম্রাজ্যবাদী হয়ে আশপাশের দেশগুলোর ওপর খবরদারি-কর্তৃত্ব কায়েম করে রেখেছে।

লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী’ গানটি একসময় ঘরে ঘরে বাজত। রেডিওতে বাজত। নানা অনুষ্ঠানে গাওয়া হত। কিন্তু এই গানটি এখন আর শোনাই যায় না। অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ধর্মীয়ভাবে উগ্রবাদী দলগুলো ও নানা জঙ্গিগোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, সেখানে ক্ষুদিরামকে স্মরণ করা ও তাঁর আদর্শকে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেওয়া খুব জরুরি। মানুষের মনন জগত থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে ক্ষুদিরামের মতো মহান দেশপ্রেমিকদের সামনে আনার আয়োজন বাড়ানো দরকার। শিশুকাল থেকেই যেন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, তিতুমীর, সূর্য সেনদের ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মনে লালন করতে শেখে। দেশের স্বার্থ, দেশের মানুষের কল্যাণকেই যে সবকিছুর, এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতে হবে—এই বোধ তৈরি হয়।