নায়কদের রাজা

Looks like you've blocked notifications!

নায়করাজ রাজ্জাক। শোবিজের মানুষ ছিলেন, অথচ কোনো স্ক্যান্ডাল নেই তাঁর! রুপালি পর্দার যে জগতে বিতর্ক, স্ক্যান্ডাল আর হতাশা নিত্যসঙ্গী, সেখানে এ রকম শীর্ষ আসনের তারকাটির এসবের বালাই ছিল না। রুপালি পর্দা, সংসার ও ব্যক্তিজীবনে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর অভিনীত ‘বড় ভাল লোক ছিল’র মতো করে বলা যায়, সত্যিকারের বড় ভালো লোক ছিলেন তিনি। সুদর্শন এবং একই সঙ্গে রাজা হয়েও তাঁর মধ্যে সেসব নিয়ে অহমিকা ছিল না।

নব্বই বা তারপরে জন্ম নেওয়া আজকের তারুণ্য সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকের ওয়াল দেখে, নায়করাজ রাজ্জাকের জন্য ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাহাকার দেখে হয়তো বিস্মিত হচ্ছে। তারা ভাবছে, কী এমন অভিনেতা ছিলেন তিনি? কিন্তু তারা তো জানে না, রাজ্জাক কীভাবে দেশের চলচ্চিত্রে রাজ করে নায়করাজ হয়েছেন? তারা তো জানে না, সাদা-কালোতেও সিনেমা হলগুলোতে রঙিন আলো ছড়াতেন নায়করাজ? আমাদের সোনালি শৈশব কতটা মধুর করে দিয়েছিলেন এই সিনেজাদুকর। তাঁর নামের সঙ্গে যে ‘রাজ’ শব্দটা যুক্ত, সেটি তিনি নিজেই বসাননি, তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেসাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক প্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরী দিয়েছিলেন। এটি আসলে সমগ্র দর্শকেরই মনের কথা।

আজকের যুগে যেখানে দর্শকরা সব নায়িকার সঙ্গেই নায়ককে গ্রহণ করতে চান না, সেখানে এই জুটি সংকট নায়করাজের জীবনে কখনোই ছিল না। রাজ্জাক তাঁর সময়ের শীর্ষ নায়িকা যার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন, দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুজাতা—এঁদের সঙ্গে অভিনীত রাজ্জাকের ছবিগুলো তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল তিনি সব চরিত্রে একেবারে মিশে যেতে পারতেন।

তাঁর প্রভাব তৎকালীন সমাজের দর্শকদের ওপর কতটা ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। একজন আবদুর রাজ্জাক যেন ঢাকার চলচ্চিত্রে এসেই ‘এলেন, দেখলেন আর সবার মন জয় করলেন।’ তাঁর সুন্দর চেহারা আর মাঝারি উচ্চতার একহারা গড়নটি লুফে নেয় দর্শক। এ যেন রুপালি পর্দায় তরুণদের নিজেদেরই প্রতিনিধিত্ব। নায়করাজের কণ্ঠটাও ছিল অসাধারণ। রুপালি পর্দার দর্শকের মন জয় করার জন্য সম্ভবত আর কোনো মাল-মসলার দরকার ছিল না।

এই সিনেজাদুকরের প্রভাব সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দেশে আজকে যত মধ্যবয়সী রাজ্জাক নামের মানুষ আছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, তাদের অনেকেরই নাম রাখা হয়েছে এই নায়করাজের প্রতি ভালোবাসা থেকে উৎসাহিত হয়ে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে তাঁর চলচ্চিত্রের প্রভাব এমনটাই ছিল। সুন্দর চলচ্চিত্র আর দুর্দান্ত নায়কদের প্রভাব এমনই হয়। নায়ক পর্দায় সিগারেট খেলে, তখন দেখতাম হল থেকে বের হয়ে দর্শক-ভক্তরাও সিগারেট খাচ্ছে। নায়ক মানবতাবাদী হলে, দর্শকরাও মানবতাবাদী হচ্ছে। কিন্তু আজকের যুগে এ দেশে সেই আদর্শ ও প্রভাব সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র কই? সেই সুদর্শন মেধাবী নায়ক কই? ষাটের দশকের নায়করাজ রাজ্জাক আর নব্বই দশকের সালমান শাহ, এ দুজনকে ব্রাকেটবন্দি করলে এর বাইরে আমাদের চলচ্চিত্রের নায়কদের নিয়ে ধুঁ ধুঁ মরুভূমির হাহাকারই শুধু চোখে পড়ে।

আমরা সেই সময়ে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে মনোজগতে একেকজন রাজ্জাক হয়ে যেতাম। এখন আমরা ছবি দেখে হল থেকে বের হই, আমাদের মনোজগতে আর সেই নায়ক বাস করে না। সিনেমা হল থেকে বের হলেই সেই ঘোর কেটে যায়, নায়ক আর হই না। এখন কেউ আর ভালোবেসে নায়কের নামে বাচ্চার নাম রাখে বলে শুনি না। চলচ্চিত্র যে তরুণদের চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে, সেরকম কোনো চলচ্চিত্র এখন দেখি না।

নায়করাজের বিদায়ে বাংলা চলচ্চিত্রের যে শূন্যতা এলো, তার পরিমাপ করা দূঃসাধ্য। লেখা শেষ করব তারই এক সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ দিয়ে। একবার নায়করাজ বলেছিলেন, ‘জীবনে আমার আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। সবই আমি পেয়েছি।’

শুধু একজন চলচ্চিত্র নায়ক নয়, এ রকম একটি জীবন সবারই প্রার্থিত। তিনি সেই পূর্ণ জীবন কাটিয়ে সার্থক মানুষ হিসেবেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

‘শিল্পী হিসেবে তিনি যেমন অসাধারণ, মানুষ হিসেবেও তেমনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁর মধ্যে অহমিকা দেখিনি। অত্যন্ত পরিশ্রমী, সহশিল্পীদের সঙ্গে সদালাপি এবং চলচ্চিত্রের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তাঁকে কখনো দূরের মানুষ মনে হতো না। হি ওয়াজ আ নাইস ম্যান, আ লায়নহার্টেড ম্যান।’ এ কথাটি চলচ্চিত্র অভিনেতা সোহেল রানার।

এ কথাটি শুধু সোহেল রানারই নয়, যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন; সবারই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।