প্রতিক্রিয়া
রাজনের বাড়িতে একদিন
সিলেটের নিহত শিশু সামিউল আলম রাজনের মা-বাবার জন্য প্রতিটি দিনই অতীব কষ্টের, কান্নার, হাহাকারের। ঈদুল ফিতরের দিনটিও ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। তাঁরা হলেন সেই ভাগ্যাহত মা-বাবা, যাঁদের ১৩ বছরের ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যাই শুধু নয়, সেই দৃশ্য ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয় কিছু মানুষরূপী জানোয়ার।
ঈদের দিন দুপুরে সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামে রাজনের বাড়িতে গিয়ে হয়ে গেলাম বাকরুদ্ধ। একটি ঘরে রাজনের মা, ফুফু ও দাদি জড়াজড়ি করে কাঁদছেন। যা দেখে উপস্থিত সবাই চোখের জল ফেলছেন। মনে প্রশ্ন জাগল, কী দোষ ছিল নিষ্পাপ শিশুটির? কেন বাস্তবতা এত ভয়াবহ? যে ছেলেটি নতুন পোশাকে সেজে বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেত, মায়ের হাতের বানানো রুটি, সেমাই, পিঠা, সন্দেশ খেত, সে এখন ঘুমিয়ে আছে কবরে। এ রকম মৃত্যু কোনো মা-বাবার পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
আমি অপেক্ষা করছিলাম, কখন রাজনের মা লুবনা বেগমের সঙ্গে কথা বলার একটু সুযোগ পাব। তিনি তখন জায়নামাজে বসে অবিরাম অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলেন। পরিশেষে উনি বিছানায় এসে আমার পাশে বসলেন। কী বলে সান্ত্বনা দেব সন্তানহারা এই মাকে। তিনি বল্লেন, ‘তারা আমার ছেলেরে মরণের সময় একটু পানিও খেতে দিল না। অনেকেই টাকা-পয়সা দিয়া সাহায্য করছে। আমরা তো চিরকালই গরিব ছিলাম। আমি কোনো টাকা চাই না। ছেলেকে তো আর ফেরত পাব না। আমার ছেলের হত্যাকারীদের উপযুক্ত বিচার চাই। আপনাদের সহযোগিতায় আশা করি খুনিদের বিচার হবে।’
রাজনের ছোট ভাই সাজনের হাতে দেখতে পেলাম একটি ক্রিকেট ব্যাট। তার কাছ থেকেই জানা গেল এই ব্যাট রাজনের। দুই ভাই মিলে এটা দিয়ে খেলত তারা। সাজনের চোখে-মুখে ভাইকে হারানোর বেদনা। দেখে বড় মায়া লাগল। সে বলল, ‘আমাদের কোনো ঈদ নাই। ভাই হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’ আসলেই এত অল্প বয়সে ভাইকে হারিয়ে সাজন বুঝে নিয়েছে, এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর।
পরিবারের অন্য সদস্যরা জানালেন, রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমানকে চিকিৎসকের পরামর্শে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। তিনি ঘুমাচ্ছেন। ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে আর খেতে পারছেন না। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। রাজনের এক চাচার ঘরে তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। সেই ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে এলাম। রাজনের ঘটনা জানার পর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজন এই বাড়িতে আসছেন। আজিজুর রহমানকে নানাবিধ প্রশ্ন করছেন। জানা গেল, সবার পশ্নের উত্তর দিতে দিতে প্রতিবারই উনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
পরিবারের সদস্য আর প্রতিবেশীরা জানালেন, আরো ৮-১০ জন কিশোরের মতোই ছিল রাজন। তাঁকে নিয়ে পরিবারের সবার ছিল কত স্বপ্ন। সবার সাথেই সে ভালো ব্যবহার করত। ছিল হাসিখুশি, ভদ্র। তার পক্ষে চুরি করা সম্ভব নয়। তাকে যারা খুন করল, আল্লাহ যেন তাদের জাহান্নামেও ঠাই না দেন।
বিচারহীনতাই আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যত দিন পর্যন্ত না এখানে ন্যায় বিচার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, ততদিন পর্যন্ত এভাবেই খালি হবে আরো আরো মা-বাবার বুক। এভাবেই কি টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাঠানো হবে অপরাধীদের? কী কারণে মিথ্যা ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে পৈশাচিকভাবে খুন করা হলো রাজনকে, তা আমরা জানি না। সুষ্ঠু তদন্ত হলে অবশ্যই কারণটা বের হয়ে আসবে। সব অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে হবে আমাদেরই। আর এতে রাজনের আত্মা শান্তি পাবে। ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে যুবক নিহত, ছিনতাইকারীকে গণধোলাই দিয়ে হত্যা, এ রকম সংবাদ আমরা আর দেখতে চাই না। আমাদের মধ্যে জেগে উঠুক মনুষ্যত্ববোধ।
লেখক : সাংবাদিক