‘ইহা রম্য রচনা হইতে পারিত’

Looks like you've blocked notifications!

‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল।’

ছোটবেলা স্কুলের পরীক্ষায় এই ট্রান্সলেশনটা করেনি এমন ছাত্র কমই পাওয়া যাবে। অনেক দিন পর এই ট্রান্সলেশনটির কথা মনে পড়ল আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের একটি উদ্যোগের অব্যবস্থাপনার নমুনা দেখে। বিষয়টি নিয়ে একটি দৈনিকে বরিশালের খ্যাতিমান সাংবাদিক এম জসীম উদ্দীনের প্রতিবেদন পড়ে কিছুতেই এটা নিয়ে লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।

আমরা জানি, বছরে দু-একবার ডিম ছাড়ার সময় সরকারিভাবে ইলিশ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, যাতে করে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ প্রজননের সময় জেলেদের হাতে ধরা না পড়ে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কারণ, আমাদের জাতীয় এই মাছটির সুনাম দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন গল্পও চালু আছে, আমরা যারা দেশে বাস করি, তারা যে ইলিশ খাই, তা অনেক দিনের বরফ দেওয়া অবস্থায় থাকার পর। আর মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষ নাকি আমাদের চেয়ে টাটকা ইলিশ খায়, আর সেটা আমাদের দেশের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ। আমরা রীতিমতো গর্বিত এই ইলিশকে নিয়ে। এমন ইলিশের দেশে আমরা জন্মলাভ করে যেন ধন্যই হয়েছি।

আমার প্রসঙ্গ ইলিশ নিয়ে রচনা তৈরি নয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা নিয়ে। তো, ফিরে আসি পুরোনো বিষয়ে। আগে সরকার সাত দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করত। গত বছর থেকে তা বাড়িয়ে ২২ দিন করেছে। খুবই ভালো ও মহৎ উদ্যোগ। কারণ, মা ইলিশ সবাই তো আর একসঙ্গে প্রজনন করবে না, নিয়ম করে। কেউ আগে, কেউ পরে সুবিধাজনক সময়ে কাজটি করবে। মাছেদের সমাজে তো আর আমাদের মতো শল্যচিকিৎসক নেই, যারা শিশু পয়দা হওয়ার আগেই টাকার জন্য কেটেকুটে থুক্কু সিজার করে নবজাতককে পৃথিবীর মুখ দেখাবেন। শুনেছি, চিকিৎসকরা নাকি প্রসূতির আত্মীয়স্বজনকে হুমকি আর ভয়ভীতি দেখিয়ে বলে, পরে জন্ম নিলে শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে কিংবা এমনও নাকি বলে, মায়ের মৃত্যু হতে পারে, তাই দ্রুত সিজার করিয়ে বাচ্চা প্রসব করাতে হবে। যাক সে কথা, মা ইলিশ মাছ প্রাকৃতিক নিয়মেই ডিম ছাড়বে, তাই তাদের সময়টা একটু বেশি হলেই ভালো। সে জন্যই সরকার নিষেধাজ্ঞা এক সপ্তাহের জায়গায় বাড়িয়ে ২২ দিন করেছেন। ভাগ্যিস, আমাদের চিকিৎসকদের মতো সরকার নিষ্ঠুর হননি।

সরকারের এই উদ্যোগ শুধু মহৎই নয়, মানবিকও বটে। তারা এ সময় জেলেরা কী খাবে? সেটাও ভেবেছেন। উপকূলসহ দেশের ২৫টি জেলার তিন লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২ জেলের তালিকা করেছেন। এই জেলেদের মাথাপিছু ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২০ কেজি করে চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাতে করে মাছ না ধরায় তাদের আয় থাকবে না, তারা যেন খেতে পায়, তাই এই চাল তাদের দুর্ভোগ লাঘব হবে, সেই চেষ্টাটা মাথায় রেখেছে সরকার।

কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তা খুবই উপহাস এবং রসাত্মক মনে হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে জানা গেল, নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে ১ অক্টোবর থেকে। শেষ হবে ২২ অক্টোবর। অর্থাৎ জেলেরা হাত গুটিয়ে সরকারের ২০ কেজি চালের অপেক্ষায় আছে ১ অক্টোবর থেকে। আর গত ১২ অক্টোবর বরিশাল ও বরগুনার জেলা প্রশাসকের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে ২০ কেজি করে চালের বরাদ্দপত্র এসেছে। এখন জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট ইউএনওর কাছে তা পাঠাবে। তারা জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দুস্থ জেলেদের তালিকা করে চাল বরাদ্দ দেবে। তার মানে কী? নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হয়ে আসছে আর চালের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে জেলেরা চাল নিতে যাবে। তা হলে এই যে ১ অক্টোবর থেকে তারা অভাবের ভেতর দিয়ে দিন কাটাল, এর দায় কার ওপর বর্তাবে?

এর সঙ্গে কি ওই যে ছোটবেলা স্কুলের পরীক্ষার খাতায় করা ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’ ট্রান্সলেশনের মিল পাওয়া যাচ্ছে না? না খেয়ে খেয়ে দুস্থ জেলেরা যখন বিছানায়, তখন তার দুয়ারে ২০ কেজি চাল এসে পৌঁছল। তাও যদি ভাগ্য ভালো হয় ওই জেলের। কারণ, ওই প্রতিবেদনে এমন খবরও আছে কোথাও কোথাও সহায়তার চাল সংশ্লিষ্ট ইউপির জনপ্রতিনিধিরা তাদের পছন্দের লোকদের দেওয়ায় প্রকৃত জেলেরা সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

হায়রে আমাদের জনপ্রতিনিধি। হায়রে আমাদের মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কেন চালের বরাদ্দপত্র পাঠানো হলো না জেলা প্রশাসকদের কাছে। তা হলে তো জেলেরা ১ বা ২ বা ৩ অক্টোবরে চাল পেয়ে যেত। অন্যদিকে মা ইলিশ মাছ ধরার অপরাধে এর মধ্যে ৪০০ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ঠিকই দেওয়া হয়েছে। গ্রাম্য প্রবাদটা মনে পড়ে গেল, ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই।’ সরকার সঠিক সময়ে জেলেদের কাছে চাল পাঠাতে পারেনি এটা কোনো দোষ না, কিন্তু অভাবের তাড়নায় যখন কোনো জেলে ইলিশ ধরেছে, তখন তাদের ধরে সাজা ঠিকই দেওয়া হয়েছে।

শেষ করি ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা বরগুনার পাথরঘাটার মঠেরখাল গ্রামের এক জেলে জাফর হাওলাদারে কথা দিয়ে। তিনি প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘অবরোধ (নিষেধাজ্ঞা) প্রায় শ্যাষ। এত দিন প্যাডে পাথর বাইন্ধা বউ-বাচ্চা লইয়া রইছি। এহন হুনি ২০ কেজি চাউল দেবে। কবে দেবে ঠিক অয় নায়। চাউল হাতে পাইতে পাইতে অবরোধ শ্যাষ অইয়া যাইবে।’

এখন আল্লাহ না করুক, জাফর জেলের পরিবারের কোনো সদস্য যদি মারা যায় খেতে না পেয়ে, তাহলে কি ওই যে ছোটবেলা করা ট্রান্সলেশনটির কথা মনে পড়বে না।

তখন ওই সাংবাদিক এম জসীম উদ্দীন সংবাদ করবে ‘চাল আসার আগেই জেলে পরিবারের সদস্য মারা গেল।’

আমরা ও রকম সংবাদ পড়তে চাই না। আগামীতে চাই, মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই যেন দুস্থ জেলেরা চাল পেয়ে যায়, সেই ব্যবস্থা করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’ এই লাইনটি যেন আমাদের মনে আর না উদয় হয়।

লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।