স্মরণ
দীপন হত্যার বিচার কি আদৌ হবে?
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য লেখক-ব্লগারদের মেরে ফেলার যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, তার ভয়াল বৃত্ত থেকে এখনো বের হওয়া যায়নি। এর প্রধানতম কারণ সুনির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করে সাজা কার্যকর করে উগ্রবাদী মতাদর্শীদের তেমন কোনো সংকেত দিতে পারেনি দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। অতিসম্প্রতি জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও না কোথাও জঙ্গি আস্তানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তাই বলা যায়, উগ্রবাদী মতাদর্শীদের মধ্যযুগীয় চক্রজালের হুমকিটাকে এখনো নিরোধ করা যায়নি।
কোনো বৈষয়িক শত্রুতা নয়, কেবল লেখালেখি করতে গিয়ে গত দু-তিন বছরে রাজীব, দ্বীপ, জগৎজ্যোতি, অভিজিত, ওয়াশিকুর, অনন্ত বা নিলয় এবং ধর্মীয় মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে দুই বিদেশি ইতালীয় ত্রাণকর্মী সিজার তাবেলা ও জাপানি নাগরিক কোনিও হোশি হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা। এবং যথারীতি এসব ঘটনায় জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা তথা আইএস দায় স্বীকার করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত লেখক অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের মৌলবাদী সংগঠন তাদের যাত্রা শুরুর দিকে মুক্তচিন্তা প্রকাশকারী লেখক-ব্লগারদের তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ্য ধর্মসভায় তাঁদের কতল করা ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছিল। হেফাজতি মৌলভিদের এমন প্রচ্ছন্ন মদদে উগ্রবাদীরা সঙ্গোপনে একের পর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। বিদেশি নাগরিক থেকে শুরু করে ব্লগার, শিক্ষক, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ সাধুও জঙ্গিদের হামলার শিকার হন। সে সময় ক্ষমতাসীন পলিটিশান ও সরকারের আরক্ষাবাহিনী এসব হত্যার নিন্দা, প্রতিবাদ বা প্রতিকার না করে পুরোদস্তুর মৌলভিদের সুরে কথা বলতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকার এসব হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপায় বিরোধী দলের ওপর। দেশে কোনো জঙ্গি নেই বলে প্রচার করতে থাকে সরকারি এজেন্সিগুলো। আর তাদের এমন ‘ডিনায়াল’-এর ভয়াল ফল ফলে ১ জুলাই ২০১৬ তারিখ রাতে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় আগতদের জিম্মি করে ভারতীয়, জাপানি ও ইতালিয়ান নাগরিকসহ ২০ জনকে খুন করে সংঘবদ্ধ জঙ্গিরা। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সেই ট্র্যাজেডিতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাও প্রাণ হারান। খুব স্বাভাবিকভাবেই সে সময় রক্তভেজা এ জঙ্গি হামলাকে তাই ‘জঙ্গি দমন নয়, বিরোধী দমনের প্রায়শ্চিত্ত’ বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
সামগ্রিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং হেফাজতি মৌলভিদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থান কৌশলের কারণে বর্তমানে জঙ্গি হামলা পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আগের ঘটনাগুলোর কোনোটারই সঠিক সুরাহা কিংবা বিচার না হওয়ায় পুনরায় জঙ্গিদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার শঙ্কাটা রয়েই গেছে। আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারব, এমন আশাবাদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারো মধ্যেই নেই।
এ বছর ৩১ অক্টোবর জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকার ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার দুই বছর পূর্ণ হলো। তবে দুই বছরেও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গেল ২৪ মাসে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় ২২ বার পিছিয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ অক্টোবর আদালত এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২১ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। জানা যাচ্ছে, দীপন হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা তিনজনই হত্যার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। আরো কিছু আসামির নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো ছদ্মনাম হলেও শনাক্ত করে বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেলে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান ওই বছরের ২ নভেম্বর শাহবাগ থানায় মামলা করেন। এর নম্বর ৩। পরে মামলাটি তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দক্ষিণ বিভাগ।
কার্যত ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তমনা ব্লগার, মৌলবাদের সমালোচক, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষকসহ অন্যরা যাঁরা হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের কারো তদন্তই অনুপুঙ্খভাবে নিষ্পত্তি করা যায়নি। অকালে প্রাণ হারানো সমাজের এসব প্রগতিশীল মানুষের স্বজনরাও আর বিচার প্রাপ্যতার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারছেন না।
দুই বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার বিচার শুরু না হওয়ায় তাঁর শোকগ্রস্ত বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক গণমাধ্যমকে আক্ষেপ নিয়েই বলেছেন, ‘প্রতিদিন টেলিভিশনের পর্দায় যে কান্নাকাটি দেখি, এর কি কোনো প্রতিকার আছে? এগুলো দেখে কষ্ট পাই, জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে বিচার চেয়ে কোনো লাভ আছে?’
দীপনের লাশ দেখার দিনই তাঁর শোকবিহ্বল বাবা বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না। তা ছাড়া দীপন হত্যার বিচার করলে এখন আমাদের পরিবারের কোনো লাভ নেই। কারণ আমরা তো আর তাঁকে ফিরে পাব না। বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। এটা যদি আমাদের পারিবারিক ঝগড়া বা কলহের জন্য হতো, তাহলে আমাদের লাভ-লোকসানের বিষয় আসত। পরিবারের লোক কি আসামিকে শাস্তি দিতে পারবে?’
ধর্মের মোড়কে দেশে যে জঙ্গিবাদের আগাছা বেড়ে উঠেছে, তার মূলোৎপাটনে জরুরি দল-মত নির্বিশেষে প্রগতিশীলদের জাতীয় ঐকমত্য স্থাপন। মানুষ তাঁর স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবে এমন নিশ্চয়তা সরকারকেই দিতে হবে। স্বীকার করতে হবে দেশে জঙ্গিরা অন্ধকার চাষ করছে এবং তাদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মভিত্তিক দলগুলো। গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ না দিলে নিপীড়িত কোণঠাসা মানুষের অবদমন নিশ্চিতার্থেই জঙ্গিবাদকে উসকে দিতে থাকবে। মুক্তমত সুরক্ষার মাধ্যমে মানবিক ঔদার্যকে প্রাধান্য দিয়ে মৌলবাদের গোঁড়ামির রাশ টেনে ধরা তাই সময়ের দাবি। দোষীদের গ্রেপ্তার, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে দেশে বিচার প্রাপ্যতার সংস্কৃতি তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হবে না। বন্ধ হবে না জঙ্গি হামলা, হত্যা, ধর্ষণ বা আত্মহত্যা।
সরকারের ভেবে দেখবার সময় এসেছে তারা পশ্চাৎপদ শক্তির কাছে মাথা নুইয়ে ব্যর্থ হবে নাকি দুষ্টের দমনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার রক্ষায় ব্রতী হবে। আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহারির দুষ্টু চোখ এই উপমহাদেশের দিকেই। এতদাঞ্চলে তাঁর অতিধার্মিক জিহাদিস্ট শিষ্যসাবুদেরও অভাব নেই। তারওপর দেশে মিয়ানমার থেকে আসা ছয় লাখ রোহিঙ্গার অতিরিক্ত বোঝা। যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। আবার সামনে জাতীয় নির্বাচন। সময়টা তাই রাজনৈতিক ভজঘট পাকানোর জন্য বড় বেশি উপযুক্ত। জঙ্গিবাদী অথবা স্বার্থপর ষড়যন্ত্রীদের রক্তচক্ষু সামাল দেওয়ার দক্ষতা ক্ষমতাসীনদের আছে তো?
ভয় দেখিয়ে লেখকদের লেখা বন্ধ না করে ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূকদের মানবিকতা শেখানো হোক। রক্ত দিয়ে মতের নিদান না করে পাল্টা মত প্রকাশের মাধ্যমে মরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষাটা ছড়িয়ে যাক সবখানে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হলো’! সংবিধানের এমনধারা সমুন্নত রাখার দায় সবার। স্বাধীন মত প্রকাশ কিছুতেই বৃত্তবন্দি না থাকুক। দেশটা হোক আলোর পথের যাত্রী দীপনের মতো প্রগতিপুত্রদের।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।