পাঠকের কলাম

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এমন কেন?

Looks like you've blocked notifications!

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখলে পুরো দেশের অবস্থা বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হলে দেশ ভালো হবে।’

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলাদা ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। দেশের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম কাতারে থেকে অংশগ্রহণ করেছে। বাঙালি জাতীয় চেতনার ধারক ও বাহক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। ১৯৭১ সালের আগে বর্তমান বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তিনটি। সবচেয়ে পুরোনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর প্রতিষ্ঠা হয়েছে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা অন্দোলন, ৬৬-এর ৬ দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অসামান্য ভূভমিকা।

বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪০টি। কিন্তু বর্তমানে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, নিয়োগ-বাণিজ্য, শিক্ষকদের লাল-নীল-আসমানী দল, বিভক্তি, মন্দ ছাত্ররাজনীতি, গবেষণাবিমুখতা, উপাচার্যের গাড়ি ও বাড়ি বিলাসিতা, উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির নেতাদের দ্বন্দ্ব, উপাচার্যের কার্যালয়ে তালা, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের লেজুড়বৃত্তি ও ক্যাম্পাসে সহনশীলতা ও গণতন্ত্র চর্চার অভাব। এসব নিয়ে দৈনিক পত্রিকাগুলোকে নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ১০টি খবরের আটটিই জনসাধারণকে হতাশ করে।

সর্বশেষ দুঃখজনক ঘটনাটি আমরা দেখলাম ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ে শিক্ষকদের দলাদলি ও চূড়ান্ত পর্যায়ে দুই গ্রুপের হাতাহাতি, টানাটানি ও কিল-ঘুষি। এটি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। শিক্ষকদের দলাদলি নতুন কিছু নয়, কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বার্থকেন্দ্রিক রেষারেষি চরম পর্যায়ে উঠেছে।

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় কুমিল্লা বিশ্বব্যিালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির দ্বন্দ্বের জেরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা প্রায় ৫৪ হাজার শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তায় ফেলে অনিবার্য কারণে স্থগিত করেছে। একই অবস্থা জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না উপাচার্য। কদিন আগে উপাচার্য ভর্তি পরীক্ষার মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে তিনি বাধাপ্রাপ্ত হন এবং একপর্যায়ে আহত হন। এমন অবস্থায় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর নতুন নেতৃত্বের জন্য ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচন হয় না। পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একসময় রেওয়াজ ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভুলেও নির্বাচনের কথা বলেন না। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসের আধিপত্য ও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আদর্শিক চর্চার পরিবর্তে চর্চা হয় আধিপত্য, স্বার্থ ও নেতাদের তোষামোদের। ছাত্র-রাজনীতির কারণে প্রায়ই ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।

বর্তমানে ছাত্র-রাজনীতির চেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে শিক্ষক-রাজনীতি। শিক্ষকরা যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ক্যাম্পাসকে রাজনীতির খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছেন। যে শিক্ষকদের ক্লাসে থাকার কথা, তাঁদেরকে চোখে পড়ে একে অপরকে দায়ী করার মানববন্ধনে। খুব জোরেশোরে শোনা যায় তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য। এমনো অভিযোগ রয়েছে অনেক শিক্ষক ৯-১০ ক্লাসে তিন ক্রেডিটের কোর্স শেষ করেন। গবেষণায় তো কোনো ভূমিকা রাখতেই পারছেন না, এমনকি শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে তাঁরা স্পষ্ট ব্যর্থ।

শিক্ষক সমিতিগুলো স্বার্থকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে উপাচার্যকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেন। শিক্ষক নিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে উপাচার্যের পক্ষালম্বন ও সমিতির নির্বাচনে ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তা। শিক্ষকদের রাজনীতির মূলে রয়েছে প্রশাসনিক পদ, ডরমেটরি ব্যবহার, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়া, পদোন্নতি ও অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়গুলো।

বরাবরই উপাচার্যের শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, প্রথম তিন বছর ভালো থাকলেও অজানা কারণে শেষ বছরে ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়। তাঁরা নতুন ভিসিকে আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্যাম্পাসের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তোলেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের শেষ বছরে আন্দোলন করা শিক্ষক জোটের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মানেই উপাচার্যের কর্তৃত্ব। উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, পছন্দের ব্যক্তিদের প্রশাসনিক পদে বহাল ও তাড়াতাড়ি পদোন্নতি, ফান্ডের অতিরিক্ত টাকা উত্তোলনসহ নানা অভিযোগ শোনা যায়।

শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঘোলা করার।

শিক্ষকদের উচিত হবে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া, নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তোলা, শিক্ষকতার পেশাকে লোভনীয় পেশা না ভাবা ও সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা করা। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত হবে শিক্ষকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করা এবং ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সহযোগিতা করা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতার খবর শুনলে কষ্ট ও মায়া লাগে সাধারণ শ্রমিক, কর্মচারী, কৃষক ও অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। যাদের ঘামে ভেজা করের টাকায় শিক্ষকদের বেতন ও অফিসের এসি লাগানো হয়, ব্যবহার করা হয় দামি দামি গাড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। শুভবুদ্ধির উদয় হোক, ক্যাম্পাসে জ্ঞানের চর্চা হোক, জয় হোক প্রকৃত শিক্ষকদের।

লেখক : শিক্ষার্থী, সিএসই বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।