রম্য

ক্যাম্পাসে ‘প্রেম’ সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি!

Looks like you've blocked notifications!

সাবধানতা যে কী জরুরি জিনিস তা বুঝা যায় সামান্য একটি অসতর্কতার ঘটনা থেকেও। এ রকমই একটি গল্প বলছি। ঢাকার সাংস্কৃতিক রাজধানী টিএসসিতে একদিন এক সান্ধ্য আড্ডায় বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। বন্ধুরা মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বন্ধুরা। এরমধ্যে ছেলেমেয়ে দুই কিসিমেরই বন্ধুরা আছে। তুমুল হৈ চৈ চলছে। আনন্দে ভাসছে সবাই। আনন্দে ভাসবারই কথা। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের মিশ্রণ হলে যা হয় আরকি, সেটির উচ্ছ্বাস একটু বেশিই হয়। আবার এ যুগে প্রাণখোলা আড্ডা মানেই অসংখ্য সেলফি তোলারও হুল্লোড়। এরাও তুলেছে সেলফি। এদের মধ্যে একজন আবার সেই ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ক্যাপশন লিখে দিয়েছে, ‘এক প্রেমে বন্দি আমরা’।

যাইহোক। এটা চোখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তৃপক্ষের। তিনি আবার খুবই দায়িত্ব সচেতন মানুষ। ফলে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠিকই নজরদারির চোখ রেখেছেন। শিক্ষার্থীরা সারাক্ষণ টিএসসিতে কী করে সেটা দেখার জন্য দুই চোখ খুলে রাখেন তিনি। ফলে পোস্টটি তার চোখে পড়ে গেছে। দেখে তিনি ত রেগেমেগে ভিসুভিয়াস। ‘আজ ওদের একদিন কি আমার দশদিন’ বলে গর্জন শুরু করলেন তিনি। তার গর্জনের ঝংকার এমনই যে ক্যাম্পাসের সব আবাসিক হল থেকে সেটা শোনা গেল। সবাই জেনে গেল, টিএসসিতে আজকে সন্ধ্যার পর যাকে পাওয়া যাবে, তার খবর আছে। একটা কুরুক্ষেত্র হবেই হবে।

হলোও তাই। সেই ভার্সিটি কর্তা প্রথমেই ঢুকলেন টিএসসির সুবজ চত্বরে। গিয়েই পেলেন কয়েকজনকে। ভাবলেন বহিরাগত হবে। পরে জানা গেল তারা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রথম বর্ষের নিরীহ শিক্ষার্থী। এ সময় কর্তা স্যার তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় দিলে তিনি বললেন, এসব কী? ... ওওওও ... অ্যাই তাহলে তোমাদের প্রেমে বন্দি হওয়ার কাহিনী! ভাগো এখান থেকে।

প্রেমের কথা শুনে শিক্ষার্থীরা আকাশ থেকে পড়ল। কোথাও নিশ্চিত কোনো গ্যাপ আছে। কিন্তু গ্যাপটা না জেনে তাকে বুঝাবে কী করে। ফলে অবুঝ স্যারকে তারা যতই বুঝানোর চেষ্টা করল, কর্তা স্যার ততই ক্ষেপে গেলেন। এরপর একপর্যায়ে স্যার সবার সামনে মেলে ধরলেন ফেসবুকের সেই ছবির পোস্টখানা। একেবারে গরম গরম, নীলক্ষেত থেকে মাত্রই প্রিন্ট করে এনেছেন তিনি।

শিক্ষার্থীরা এবার তাদের ভুল বুঝতে পারল। বলল, “স্যার, স্যরি। ওটা তো ‘ফ্রেমে বন্দি’ হবে। প্রেমে বন্দি না। কী বোর্ডের শিফটে চাপ পড়েনি ঠিকমতো। এ কারণেই এই ‘ফ্রেমের’ জায়গায় ‘প্রেমের’ ভুল হয়েছে।'' স্যার মানবেনই না। সবাইকে ধমক দিয়ে বললেন, টিএসসিতে রাত ৮টার পর আর কোনো আড্ডা নয়। যার যার হলে গিয়ে হাঁস-মুরগি ঘরে তোল। দাদিকে ওষুধ দাও। পড়তে বস।

এক শিক্ষার্থী জানতে চাইল, ‘স্যার, এখানে হলে তো কোনো হাঁস-মুরগি নাই। তাহলে ঘরে তুলব কী?’ স্যার এবার আরো জোরে ঝংকার দিলেন। শিক্ষার্থীরা মাথা নিচু করে হলে ফিরে গেল।

আরেকটি ঘটনা বলি, এটি শতভাগ বাস্তব ঘটনা। এটিও নাকি ঘটেছিল এই ক্যাম্পাসেই।

সে অনেক দিন আগের ঘটনা অবশ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষক জয়েন করলেন কোনো এক ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু তিনি মোটেও ক্লাস নেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন আর যান। এমনকি কোনো ক্লাসে গেলে, তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শুধু ‘হাই-হ্যালো’ করে বেরিয়ে আসেন। এটা দেখে সবাই প্রথমে হলো আশ্চর্য এবং পরে হলো মহাআশ্চর্য। একপর্যায়ে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে গেল। সবাই ভাবল, এবার শিক্ষকের বিকার হবেই হবে। কিন্তু একি! তাতেও যে তার কোনো বিকার নেই।

পরে কোর্টে যখন তাঁকে ডাকা হলো তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলে যে ক্লাস নিতে হবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় কোথাও লেখা নেই।’

বলা বাহুল্য ওই শিক্ষক সেই মামলায় জিতে গেলেন। আসলেই সেই সময় নীতিমালায় সেটা লেখা ছিল না। পরে তা যুক্ত করা হয়েছিল।

আরো একটি ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করছি। এই ক্যাম্পাসেই এক সময় নাকি পড়ুয়া সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলতেও প্রক্টরের অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি ছাড়া কথা বললেই ৫০ পয়সা জরিমানা! সেই আইনটি এখনো বলবৎ আছে কি না জানা নেই বা সেই ধরনের কোনো আইন আদৌ ছিল কি না, তা-ও জানি না। তবে ক্যাম্পাসে এ গল্পটা শুনতাম দেদার। এখন মাঝেমধ্যেই যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই রকম আইন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, তা দেখে রোমাঞ্চিত হচ্ছি। প্রায়ই শুনি, অমুক দিন থেকে টিএসসির আড্ডা রাত ৮টার মধ্যে শেষ করতে হবে। সব দোকান-পাট অমুক সময় থেকে বন্ধ থাকবে।

এরমধ্যে প্রক্টরও নাকি ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, এখন থেকে শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যার পর নিজেদের হলে গিয়ে আড্ডা দিতে হবে। টিএসসিতে নয়। অনেকের অভিযোগ, এরমধ্যেই সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসের অনেক এলাকার চায়ের দোকানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনের এসব উদ্যোগ দেখে আমার কেবলি ৫০ পয়সা জরিমানার কথা সবার আগে মনে পড়ে যায়। আহা। সবাই আগায়, আমরা অতীতের দিকে পিছিয়ে যাই। আলো-অন্ধকারে যাই। এখনকার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শুধু বলতে চাই, আপনারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে ফেলবেন না। হয়রানিতে ফেলবেন না। শিফটটা ঠিকমতো চেপে দিয়েন। না হলে ‘প্রেমঘটিত’ ভুল বোঝাবুঝি হবেই।  

[নোট: ‘শিক্ষকের ক্লাস’ শীর্ষক গল্পটি প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ক্যাম্পাসজীবনের মৌখিক গল্প, তাঁর অনুজ আহসান হাবীবের স্মৃতিচারণা থেকে নেওয়া।]

লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন