অভিমত

রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল যেন থামছেই না। বরং মাঝে-মধ্যেই কয়েকদিনের বিরতিতে আবারও পুরোদমে দলে দলে ছুটে আসছে। পূর্বের সংখ্যার সাথে যুক্ত হয়ে এ সংখ্যা এখন ১০ লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস মতে এভাবে চলতে থাকলে তা কোথায় এসে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। একদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা অপরদিকে ষড়যন্ত্র- দুটিই যেন একে অপরের হাত ধরে চলছে। এতে বন-জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে, বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা এবং সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের। আর অর্থনীতির যে বিরাট সমস্যা হচ্ছে সেইটই আজকের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু।

স্বাধীনতার পর থেকে অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বাংলাদেশের বর্তমানে অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি একটি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের মাথাপিছু আয় প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। জিডিপিতে সব উন্নয়ন সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে চলেছে এবং ঈর্ষণীয়ভাবে তা এখন সাতের উপরে। অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন যে স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে তার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাতে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির বছর রূপকল্প-২০২১ তে এসে তা ডাবল ডিজিটে চলে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরোও স্বপ্ন দেখছেন। তারপরে চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও এমনি ইঙ্গিত রয়েছে। এরপরে এসডিজি-২০৩০ এবং ভিশন-২০৪১ তো রয়েছেই। তা ছাড়া সর্বশেষ হিসেবে বর্তমানে দেশের মাথাপিছু আয় আরেক দফা বেড়ে তা এখন ১৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

তার মানে হলো বর্তমান সরকারের অনুমিত ও পরিকল্পিত রূপকল্প অনুসারে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হবে যা সরাসরি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তবে শর্ত থাকে সেই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিকতা। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, দেশের প্রতিটি সেক্টরে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ্য করে থাকব বাংলাদেশের এসব উন্নয়নের জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা উৎসাহ দিচ্ছে কিন্তু নিন্দুকেরা চায় পিছনে টেনে ধরতে। তারা সবসময়ই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে কীভাবে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রার লাগাম টেনে ধরে রাখা যায়। সেসব ষড়যন্ত্রের কোনটা ঘটে পর্দার সামনে আবার কোনটা ঘটে পর্দার অন্তরালে।

তেমনি একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে নিয়ে। কথা উঠেছে বাংলাদেশের বর্তমানে ষোলোকোটি মানুষের সাথে মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লাখ শরণার্থীকে খাইয়ে পড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখা বাংলাদেশের সরকার এবং মানুষের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো তারা কী খেল কী পড়ল সেটা নিয়ে নয়। তাদের এখানে থাকার সাথে বিরাট অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ জড়িয়ে রয়েছে। শরণার্থীরা সমস্যায় পড়েই হয়তো সীমান্তের এপাড়ে আমাদের বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে এসেছে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কোমলমতি মানবিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আশ্রয়ের সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে আমাদের প্রতিবেশী ভারতে এমনি একটি পরিস্থিতিতে প্রচুর মানুষকে শরণার্থী হতে হয়েছিল। কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ-ভারত আবার মিয়ানমার-বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোটেও এক নয়।

এখন হয়তো দেশের অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে যেহেতু কিছু না কিছু বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে খুবই অপ্রতুল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ইতিমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে এভাবে রোহিঙ্গাদের ঢল আসতে থাকলে তাদের শুধু খোরাকির জন্য বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেটা কতদিন থাকবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। যদিও বা সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে মিয়ানমার শরণার্থীদের আগামী সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা এবং পূর্বাভিজ্ঞতা কোনটাই সুখকর নয়। কাজে যদি বছরের পর বছর তারা সেখানে অবস্থান করতে থাকে তাহলে তাদের জন্য বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তা সম্পূর্ণভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে।

ইতিপূর্বে যারা রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে সেখানে বসবাস করছে তারা সুযোগ বা ফাঁক পেলেই সেকাজ করে বেড়াচ্ছে। অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এ সুযোগে চোরাকারবারীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়া। এ চোরাকারবারীদের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে মরণনেশা ইয়াবা, বার্মিজ বিভিন্ন অবৈধ জিনিসপত্র অপরদিকে রয়েছে মানব পাচার, দালালদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি। সেসব করে প্রচুর দেশীয় মুদ্রা লুণ্ঠন করে চলেছে। এতে সার্বিক অর্থনীতি টান পড়ছে। আমরা বিগত অনেক বছর থেকে বিশেষত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলগুলোতে দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি হতে দেখা যায়নি। উপরন্তু কয়েক বছর আমরা খাদ্য কিছুটা হলেও রপ্তানি করে দেখাতে পেরেছি। নেপালের ভূমিকম্পে আমরা খাদ্য সাহায্যও পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলাম।

এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভরণপোষণসহ তাদের পিছনে যে পরিমাণ অর্থ বাৎসরিক ব্যয় হতে চলেছে এতে করে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা এভাবে আমাদের সামনের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে আমাদের অন্যান্য সৎ প্রতিবেশী এবং দীর্ঘদিনের মিত্ররা যদি সব ষড়যন্ত্রেকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে তবে আমাদের সামনের দিনগুলোতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হবে বৈকি! সেখানে চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম ও অমুসলিম দেশসমূহ শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এবং দেশের সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

তবে সেখানে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, দেশগুলো সত্যিকার অর্থেই কার্যকরভাবে আমাদের সাথে আছে নাকি আমাদের অগ্রসরমান ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কে শ্লথ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। যদি দ্বিতীয়টি হয় সেখানে আমাদের মানবতার পাশাপাশি দেশের এবং দেশের নিরাপত্তা তথা আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশের অর্থনীতির এ অগ্রযাত্রা অর্জনে আমরা যে কৌশল আয়ত্ত করে ফেলেছি তা যেভাবেই হোক না কেন ধরে রাখতে হবেই। তাতেই আমাদের দেশের অর্থনীতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আর আমাদের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ।