কেন বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি

Looks like you've blocked notifications!

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অষ্টমবারের মতো বাড়ল বিদ্যুতের দাম। নতুন নির্ধারিত দামে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিইআরসি। এই হার কার্যকর হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত আটবার বাড়ানোর হলো বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের দাম গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। তাতে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ২০ টাকা; ৬০০ ইউনিটের বেশি ব্যবহারে খরচ বাড়ে কমপক্ষে ৩০ টাকা।

চলতি বছর মার্চে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছিলেন, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করা প্রয়োজন। এরপর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত সেপ্টেম্বরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করে। সেখানে পাইকারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৬ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব আসে।

এর মধ্যে ডিপিডিসি গ্রাহক পর্যায়ে ৬.২৪ শতাংশ, ডেসকো ৬.৩৪ শতাংশ, ওজোপাডিকো ১০.৩৬ শতাংশ, আরইবি ১০.৭৫ শতাংশ এবং পিডিবি ১৪.৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, গণশুনানি করার পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানাতে হয়।

এবারও শুনানিতে বিতরণ সংস্থাগুলোর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয় ভোক্তাদের পক্ষ থেকে। ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) পক্ষ থেকে দাম কমানোর একটি প্রস্তাব নিয়েও শুনানি হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে হরতাল দিয়ে তার প্রতিবাদ জানানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বাম দলগুলো। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এলো।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে- কেন বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে? বিদ্যুৎ উৎপাদনে লক্ষণীয় উন্নতি হলেও বিদ্যুতের অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করা যায়নি কেন। আর এর খড়গ পড়ছে ভোক্তাদের ওপর। অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ না করে বারবার দাম বৃদ্ধি কেন?

শহরে সাধারণ আয়ের চাকরিজীবী যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁদের আয়ের একটা বড় অংশ যায় বাড়িভাড়া বাবদ। নতুন বছরের শুরুতে এক দফা বাড়িভাড়া বেড়েছে। বাড়িওলারা ওত পেতে আছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর জন্য।

আবাসিকে দাম বাড়ানোর সময় গতবার সরকার কয়েক ধাপ সিলিং করে দিয়েছিল। অর্থাৎ ব্যবহারের কম-বেশির ওপর দামের হেরফের ছিল। বেশি ব্যবহারে বেশি রেট। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো ভাড়াটিয়ারা এ সুযোগ পান না। কারণ অনেক ভাড়াটিয়াকেই বাড়িওয়ালা আলাদা মিটার দেয় না। সাব মিটার দিলেও মিটার রিডিং দেখে একটা ফ্ল্যাট হারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করে। ফলে বিদ্যুতের দাম কম-বেশি যাই বাড়ুক, ভাড়াটিয়াদের জন্য আরেক দফা বিপদ আসবে এটা নিশ্চিত।

প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ খাতে গৃহীত ভ্রান্তনীতির কারণেই আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার শুরুতে রেন্টালের ওপর নির্ভর করলেও ক্রমান্বয়ে দেশে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুললে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সরকারের লক্ষ্যও ছিল তাই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠলে ২০১৩-২০১৪ সাল নাগাদ বিদ্যুতের দাম কমে আসবে। তাই বলতে হয়- বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুতের দামে সামঞ্জস্য আনার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা হলো না কেন? দেশে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ আছে সত্য, তবে তা মীমাংসার যথাযথ উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়নি? বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করেও তো বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যেত।

বিদ্যুতের এই দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছে সীমিত আয়ের মানুষ। গ্রাহকদের শ্রেণিভেদে যে দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে দেখা যায়, গরিব আবাসিক গ্রাহকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ পড়বে সবচেয়ে বেশি। তবে আবাসিক খাতেই শুধু নয়, শিল্প খাতেও পড়বে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব। শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। এর মাশুলও দিতে হবে সাধারণ ভোক্তাদেরই। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট আয় ও পেশার মানুষের কষ্ট ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। অনেক পরিবার ভবিষ্যতের ভাবনা ভুলে সঞ্চয়ের অর্থও খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় আবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার স্ফীত করার মাধ্যমে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি খাতেও। কৃষকরা এমনিতেই উৎপাদন খরচের তুলনায় উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পান না সব মৌসুমে। তার ওপর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-অবরোধে তাদের ব্যাপক লোকসান দিতে হয়েছে।

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বেড়েছে- এমন খবরে সাধারণ জনগণ উদ্বিগ্ন। বিদ্যুতের দাম বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়ে জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে। আবাসিক গ্যাস বিদ্যুৎ খরচ বাড়া ছাড়াও পরিবহন ভাড়া, শিল্পপণ্যের দামেও পড়বে বিরূপ প্রভাব। গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই নাগরিকদের অর্থাৎ ভোক্তাদের স্বার্থের কথা অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। আমরা আশা করছি, অবশ্যই সরকারকে দেশের সিংহভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।

এ ক্ষেত্রে দরকার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় রোধে সরকারের প্রতি রোডম্যাপ অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের এগুতে হবে। কিন্তু প্রত্যাশানুযায়ী এগোতে পারছে বলে মনে হয় না। এতে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা, বাড়াতে হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। সরকারকে উৎপাদন, বিতরণ, লাইন সম্প্রসারণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি অপচয় ও অনিয়ম রোধে দৃষ্টি দিতে হবে। এতে গ্রাহকসেবার মান ও সন্তুষ্টি বাড়বে, অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে ত্বরান্বিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।