রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি কতটা বাস্তবায়ন হবে?

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বা ‘ব্যবস্থা’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কেন না, আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য এমন কৌশল মিয়ানমার সরকার অবলম্বন করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কিন্তু এমন শত শত নজির পাওয়া যাবে।

আমরা যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কৌশলকে বিবেচনায় নিই তাহলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বাইরে থাকা এমপিদের সংসদে ফেরার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এটা ছিল একটা ট্র্যাপ। আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর জন্য পাকিস্তান এটা করেছিল। সেটাকে ট্র্যাপ বুঝতে না পেরে যারা এসেছিলেন, তাঁদের গুলি করে মারা হয়েছে কিংবা পাকিস্তানে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

আবার পরে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার বিষয়েও পাকিস্তান লোক-দেখানো সম্মত হয়েছিল। সেটিও শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। বরং ওদের বোঝা বাংলাদেশকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই সব আস্থা রাখাটা কতটুকু সমুচিত হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।

এখন আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর জন্য মিয়ানমার যদি পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে গিয়ে আর কাউকে ফেরত না নেয়, তাহলে আমরা তখন কী করব। আবার যাদের নিয়ে গেল, তাদের যদি মেরে ফেলা হয়, তাহলে আমাদের কী করণীয় থাকবে?

আসলে বড় কথা হলো- মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঘটবে তাদের পরিচয় যথাযথভাবে যাচাই করার পর। ১৯৯২ সালে দুই দেশের তরফে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয় এর মধ্যে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা ছিল।

রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিকীকরণের বিরোধিতা করে মিয়ানমারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সমস্যা শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সমঝোতাকে ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ বা দুই পক্ষের জন্য বিজয় বলে বর্ণনা করেছে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আর গত বছর অক্টোবর থেকে জুলাই পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির অধীনে দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ছয় মাসের মধ্যে ফেরত গিয়েছিল। পরে ১৯৯২ সালে দুই দেশের মধ্যে আরেকটি সমঝোতা হয়, যার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সম্প্রতি ছয়বার প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাব চালাচালি হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয় ২৩ সেপ্টেম্বর এবং মিয়ানমারের ইউনিয়ন মন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়ে ২ অক্টোবর ফের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়। মিয়ানমার ২০ অক্টোবর এর জবাব দিলে বাংলাদেশ পুনরায় ২ নভেম্বর পাল্টা প্রস্তাব দেয়। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬ নভেম্বর পাল্টা প্রস্তাব দেওয়া হলে বাংলাদেশ এর দুদিন পর জবাব দেয়। ২২ নভেম্বর সকালে নেপিদোতে উভয় দেশের কর্মকর্তারা এর খসড়ার ব্যাপারে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের ইউনিয়ন মিনিস্টার চ টিন্ট সোয়ে এর বিভিন্ন অসামঞ্জস্য দূর করেন।

অসামঞ্জস্য দূর হলেও রোহিঙ্গা ফেরত নিতে বাধা হিসেবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে সে বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারে জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও শঙ্কিত যে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা নাও করতে পারেন।

অং সান সু চির সরকার আন্তর্জাতিক চাপের ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলে তাদের প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে দিতে পারে সেনাবাহিনী। আর সেনাদের ঠেকানোর কোনো ক্ষমতাই নেই সু চির। জান্তা প্রণীত সংবিধানেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সরকারের ভেতর আরেক সরকার।

মিয়ানমারের বর্তমান সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং চরম রোহিঙ্গাবিরোধী। তিনি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা কোনো কর্মরত সেনাপ্রধানের পক্ষে দেওয়া শুধু অশোভনই নয়, রীতিমতো ধৃষ্টতা। তবে তাঁকে ঠেকায় কে? তাই রোহিঙ্গারা নিজ ভিটাবাড়িতে ফেরত যেতে পারে, নাকি তাদের কপালে অপেক্ষা করছে অন্য কোনো দৃশ্যপট, তা কে জানে?

লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।