অভিমত

পোপের ঐক্যের ডাকে মিয়ানমার সাড়া দেবে?

Looks like you've blocked notifications!

যখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে টানাপড়েন চলছে, ঠিক সেই সময় মিয়ানমার সফর করছেন পোপ ফ্রান্সিস। তবে মিয়ানমারে নামার আগে ও পরে বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে কোনো রকম মন্তব্য না করার হুমকি পেয়েছেন তিনি। পরিচয় গত স্বীকৃতির প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের নাম উচ্চারণ করতে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকার ও বৌদ্ধবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

পোপ ফ্রান্সিস এমন সময় মিয়ানমার সফর করছেন যখন দেশটির সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নিধনের’। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ এনেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আগস্টের শেষ দিকে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। অনেকেই আশা করছেন এই সফরে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তির বাণী ছড়িয়ে ঐক্যের ডাক দেবেন পোপ ফ্রান্সিস।

এ বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালানো শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে সেনাবাহিনী। দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্ট অং সান সু চি’ও তাদের নিয়ে ইতিবাচক কোনো মন্তব্য করেননি।

এমনই এক মুহূর্তে পোপ যখন মিয়ানমার সফর করছেন তখন সবার মনে প্রশ্ন ওঠছে তাঁর এই সফর কতটা সফল হবে? লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস বলছে, পোপ ফ্রান্সিসের এই সফর মূলত কূটনৈতিক হলেও এই বাস্তবতায় এটি হবে তাঁর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক প্রতিবেদনে ওই মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি এবং দেশটির সেনাবাহিনীর আপত্তি থাকায় কার্ডিনাল চার্লস মং বো পোপকে তা উচ্চারণ করতে মানা করেছেন।

পোপের মিয়ানমার সফর শুধুই নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের আরেকটি অংশ নয়। বরং এটি ধর্মীয় মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মরিয়া এক সংগ্রামও। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ধর্মের অপব্যবহারের কারণে শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো বিশ্বেই দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ছে।

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পোপ ফ্রান্সিস ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী নেতাদের বিবেককে জাগ্রত করতে চান। তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলতে চান। এই ধর্মান্ধতা প্রায়ই রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে যায়। বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারেও এখন সেটা হচ্ছে। মিয়ানমারে আরেকটি ধর্মীয় সংঘাত ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে চান পোপ ফ্রান্সিস।

মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) মিয়ানমারের বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের অনুসারীদের মাঝে ‘বৈচিত্র্যতায় ঐক্যের’ ডাক দিয়েছেন খ্রিস্টান ধর্মের রোমান ক্যাথলিক শাখার প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। এদিন ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমারের ক্যাথলিক আর্চ বিশপের বাসভবনে ৪০ মিনিটের এক আন্তধর্মীয় বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান। বৈঠকে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর নেতারা অংশ নেন। বৈঠক শেষে রাজধানী নেইপিদোর উদ্দেশে ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করেছেন তিনি। সেখানে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন পোপ।

ইয়াঙ্গুনের ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী জাতিগত বিদ্বেষের উসকানি দাতা এক বৌদ্ধ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পোপ ফ্রান্সিস। রোহিঙ্গা সঙ্কটের মাঝে চারদিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার বিতর্কিত ওই বৌদ্ধ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।

পোপোর মিয়ানমার সফর প্রসঙ্গ আসার পর পরই বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা করেছে। এবিসি নিউজের খবরে বলা হয়েছে, জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম দেশ মিয়ানমার। বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই সেথানে কোনো না কোনোভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাসের এলাকাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান পাথরের মতো খনিজ সম্পদে হানা দিতে মিয়ানমারে বৌদ্ধদের উগ্র জাতীয়তাবাদী তৎপরতাকে ব্যবহার করা হয়। চীনের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে এসব সম্পদ উত্তোলন ও তার ব্যবহারে চুক্তিও করেছে মিয়ানমার সরকার।

সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা নয় পোপের এই সফর। এটি মানবতা ধর্ম আর কূটনীতির মধ্যে সমন্বয়। অস্ট্রেলিয়ার লোয়া ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো আরন কোনেলি সিএনএনকে বলেছেন, নিশ্চয় এই সফর কেবল একটা আনুষ্ঠানিকতা হবে না। তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় পরিষ্কার। পোপ অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলবেন। এখন প্রশ্নটা হলো তিনি মিয়ানমারকে তা শক্তভাবে বলেন নাকি বন্ধুত্বপূর্ণ পথে বলেন সেটা।’

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।