১৯৭১

হারিয়ে যাওয়া এক জ্যোতি

Looks like you've blocked notifications!

একাত্তর সালে দেশকে মুক্ত করতে প্রাণ দেওয়া এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জগৎজ্যোতি দাস। হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের জলসা গ্রামে তাঁর জন্ম। সময়টা ছিল ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত জগৎজ্যোতি ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। স্থানীয় জমিদারদের দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন জ্যোতি। সেই প্রতিবাদী জ্যোতি একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে জগৎজ্যোতি গড়ে তুলেছিলেন ‘দাস পার্টি’। সেই বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন একাধিক যুদ্ধে। আপ্রাণ চেষ্টা করে করে তাঁরা দেশকে স্বাধীন করেন। আমাদের মাঝে উপহার দেন একটি লাল-সবুজের সোনার বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক, আমরা সেই জ্যোতিকে আর ফিরে পাইনি। দেশের জ্যোতি নতুন মহিমায় প্রকাশ পেলেও আসল জ্যোতিকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলি।

’৭১ সালে সুনামগঞ্জকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে সদর উপজেলার রঙ্গারচর ইউনিয়নের বনগাঁও বাজারের পাশে বালাট সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে ১১৪ জনকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। ওই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন জগৎজ্যোতি। বিশাল ওই দলটি শিলংয়ের গভীর অরণ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার প্রতি দক্ষতা থাকায় তিনি সেই নেতৃত্বের ভার পেয়েছিলেন। সেই প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে অংশ নেন একাধিক যুদ্ধে। সাফল্যের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধে জয়ী হন তিনি। তবে একটি যুদ্ধে চিরতরে নিভে যায় সেই জ্যোতি। 

মুক্তিযোদ্ধারা ৫ আগস্টের আগে কয়েকবার জামালগঞ্জ থানা আক্রমণে গিয়েও ব্যর্থ হন। অবশেষে ওই থানা আক্রমণের দায়িত্ব পড়ে দাস পার্টির ওপর। ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধার ওই দলটি জগৎজোতির নেতৃত্বে জামালগঞ্জ থানা ও সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে। বাঙ্কারে জ্যোতির ছোড়া তিনটি গ্রেনেডে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তবে ওই অভিযানে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম এবং পায়ে গুলিবিদ্ধ হন মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস। 

ওই অভিযানের পর দাস পার্টি এক সপ্তাহ বিশ্রামের সুযোগ পায়। সহযোদ্ধাকে হারানোর শোকে কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে কয়েক দিনের মধ্যে শ্রীপুরে অভিযানে যেতে হয় তাঁদের। সেখানে ১০ থেকে ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। এই অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে তাহিরপুর থানা ও শ্রীপুর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্ত করেন জ্যোতি। এই অভিযানে জ্যোতি অ্যামবুশ তৈরি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। এর ফলে শত্রুমুক্ত হয় শ্রীপুর ও তাহিরপুর থানা।

শ্রীপুরের পর খালিয়াজুড়ী থানায় অভিযানে যায় দাস পার্টি। সেখানে জ্যোতির দল খুব ভোরে হামলা করলে রাজাকার ও পুলিশ সদস্যরা জীবন বাঁচাতে খালিয়াজুড়ী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। ওই থানা দখলে নেওয়ার জন্য জ্যোতিদের দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সেখান থেকে পাঁচটি রাইফেল ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। খালিয়াজুড়ী ত্যাগের সময় থানা ভবনও উড়িয়ে দেয় জ্যোতির দল।

ওই অভিযানের পর জ্যোতি সাব-সেক্টরে গিয়ে কাজের প্রতিবেদন দেন। এরপর দুদিন বিশ্রাম নিয়ে দিরাইয়ের কুড়িতে অবস্থিত আরপিতে অবস্থান করেন। সেখানে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ে আসা অস্ত্রের যাত্রাপথ বন্ধ করার জন্য। দাস পর্টির সদস্যরা পরিকল্পনা করে নদীর দুপাশে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানিদের মালামাল বহনকারী বার্জ আসলে সেটা লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধা ব্রাশফায়ার করে। তবে ওই বার্জে শুধু রাজাকাররা ছিল। সেখান থেকে মোট ১০টি রাইফেল ও খাদ্যসামগ্রী উদ্ধার করা হয়। পরে বার্জটি পানিতে ডুবিয়ে দেয় জ্যোতি। জ্যোতির দল কুড়িতে সফল অভিযানের পর সেখানে দুই দিন-দুই রাত অবস্থান করেন। এরপর হেডকোয়ার্টার থেকে নতুন অভিযানের নির্দেশনা আসে।

নদীপথে পাকিস্তানিদের একের পর মালামালভর্তি লঞ্চ, কার্গো ও বার্জ ধ্বংস হওয়ায় তারা নতুন করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে। এ কারণে কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামগুলোতে শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই খবর গুপ্তচরের মাধ্যমে জানতে পারেন জগৎজ্যোতি। পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ফের মুক্তাঞ্চল তাদের দখলে চলে যাবে, তাই তিনি সেখানে অভিযান পরিচালনার জন্য হেডকোয়ার্টারে অনুমতির জন্য খবর পাঠান। পরে সেখান থেকে অভিযানের অনুমতি পেয়ে তিনি ২৮ জনের একটি দল নিয়ে রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জে অভিযান শুরু করেন। প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ নিয়ে কুশিয়ারার তীরবর্তী হাওর এলাকায় নিরাপদে অবস্থান নেন। এরপর চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে সাজিয়ে নৌকায় নিয়ে পাকিস্তানের অবস্থান জানাতে পাঠিয়ে দেন। ওই চারজনের দলটি খোঁজ নিয়ে এসে জ্যোতিকে জানায়, রানীগঞ্জে এখনো পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসেনি, তবে কয়েক দিনের মধ্যে আসবে। আর সেখানে আগে থেকেই রাজাকাররা রয়েছে। তাই জ্যোতি রানীগঞ্জে তাৎক্ষণিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। দাস পার্টির আক্রমণে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হয় অন্তত ৫০ রাজাকার।

তবে কাদিরগঞ্জ বাজারের অবস্থা ছিল ভিন্ন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী তখন না পৌঁছালেও অন্তত ২০০ রাজাকার সেখানে সক্রিয়ভাবে ছিল। ওই বাজারে দাস পার্টি আক্রমণ করলে রাজাকাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে বিজয় পায় জ্যোতির দল। সেখানে চার-পাঁচজন রাজাকার মারা যায়। সেখান থেকে চারটি রাইফেল উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। জ্যোতির নির্দেশে কাদিরগঞ্জের নৌঘাটের জেটিটিও উড়িয়ে দেয় দাস পার্টি।

আগস্ট মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা দিরাই-শাল্লা থানায় হত্যা, লুটপাট ও নির্যাতন শুরু করে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর। পরে সেক্টর থেকে জ্যোতির কাছে ওই এলাকা শত্রুমুক্ত করার নির্দেশ আসে। নির্দেশ পেয়ে দাস পার্টি নদীপথে পাকিস্তানের ওপর একের পর এক আক্রমণ শুরু করে। এতে করে নদীপথে পাকিস্তানিদের চলাচল অনেকাংশে কমে যায়। জ্যোতির দল দিরাই-শাল্লা যাওয়ার পর কোনো যুদ্ধ ছাড়াই ১০ জন রাজাকারকে আটক করে। দলটি ওই এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালাচ্ছিল বলে খবর ছিল দাস পার্টির কাছে।

জ্যোতির নেতৃত্বে দাস পার্টির একের পর এক সাফল্যের কথা জেনে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা দাস পার্টিকে ফাঁদে ফেলার জন্য সেখানে তিনটি দল প্রস্তুত করে। কিন্তু সেই তথ্য জানতে পারেনি দাস পার্টি। তারা পাকিস্তানিদের ফাঁদে পড়ে যায়। 

ওই দিন সকাল পৌনে ৮টার দিকে জ্যোতির নৌকার বহর ভেড়ামোহনা নদীতে পৌঁছে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলটি বদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে যাওয়ার পর তাঁরা দেখতে পান, তিন-চারজন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটকে চাঁদা নিচ্ছে। বিষয়টি দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে জ্যোতি ওই রাজাকারদের ধরে আনতে বলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধদের দেখে পালিয়ে যেতে থাকে রাজাকাররা। পরে নাছোরড়বান্দা জ্যোতি ওই রাজাকারদের পিছু নেয়। ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি রাজাকারদের ধরতে পিছু নেন।

এ সময় জ্যোতির সঙ্গে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা গোপেশ চন্দ্র দাস (শহীদ), ইলিয়াস, মতিউর রহমান, আইয়ুব আলী, আবদুল মজিদ, নিত্যানন্দ, বিজয় দাস, ইদ্রিস আলী, আবু সুফিয়ান ও সবল চন্দ্র চৌধুরী। নদী দিয়ে সামনে এগিয়ে হাওরের মাথায় গিয়ে থেমে যায় জ্যোতিদের নৌকা। সেখানে আগে থেকেই রাজাকারদের একটি দল অবস্থান নিয়েছিল, যা জ্যোতির জানা ছিল না। জ্যোতির দল রাজাকারদের দেখে ব্রাশফায়ার করলে তিনজন মারা যায়। দুজন পালিয়ে যেতে ধরলে তাদের উদ্দেশে মর্টার ছোড়া হয়। এতে ওই দুজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তবে প্রচণ্ড শব্দে মর্টার বিস্ফোরণ হওয়ায় ও গুলি শব্দ শুনলে ওত পেতে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকার সদস্যরা জ্যোতিদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তারা পিটুয়াকান্দি, পিরোজপুর ও খইয়াগুপিতে অবস্থান নিয়ে তিন দিক থেকে বাধা সৃষ্টি করে।

জ্যোতি বিলে যাওয়ার আগে নদীতে রেখে আসা দলের কয়েকজনকে বলেছিলেন, সমস্যায় পড়লে যেন পেছন থেকে তারা ব্যাকআপ দেয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা অবস্থান নেওয়ায় তারা সেভাবে এগিয়ে আসতে পারেনি। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বিলে জ্যোতিসহ তাঁর দল অনেকটা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যায়। পাকিস্তানিদের ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল গুলি করতে করতে সামনে এগোতে থাকে। এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলার পর জ্যোতিদের অস্ত্রের মজুদ কমে যায়। শেষ পর্যন্ত জ্যোতির সঙ্গে থাকা ১২ জনের দলটির প্রায় ১০০ গজের কাছে চলে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এ পরিস্থিতিতে জ্যোতি শুধু ইলিয়াসকে সঙ্গে রেখে অন্যদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু এরই মধ্যে আইয়ুব আলীর শরীরে গুলি লাগে। তাঁকে নিয়ে পিছু হটে আরো দুজন। এ সময় আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। 

দুপুর ৩টার বেজে যায়। খাওয়া নেই, কোনো বিশ্রাম নেই। অক্লান্ত দেহ নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন জ্যোতি ও ইলিয়াস। সাড়ে ৩টার দিকে ইলিয়াসের বাঁ পাঁজরে গুলি লাগে। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে, আর সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবতে থাকে। পৌনে ৫টার দিকে একটি গুলি এসে লাগে জ্যোতির শরীরে। ইলিয়াস পেছনে ফিরে দেখেন, তাঁর প্রিয় নেতা জ্যোতির নিথর দেহটি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আর সূর্যটা নিভে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে, অন্ধকার প্রকৃতির মধ্যে জ্যোতির দেহ পানির নিচে রেখে চলে আসেন ইলিয়াস।

ইলিয়াস চেয়েছিলেন, লুকিয়ে রাখা জ্যোতির দেহটি পরে এসে নিয়ে সৎকার করবেন। কিন্তু পাকিস্তানের নরপিপাসুরা তা হতে দেয়নি। জ্যোতির দেহটি খুঁজে বের করে স্থানীয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্যোতির মরদেহ দেখেও শান্ত হতে পারেনি পাকিস্তানের হায়েনারা। সেই লাশের ওপর তারা চালায় পৈশাচিক নির্যাতন।

শেষ শক্তি থাকা পর্যন্ত জ্যোতি লড়ে গেছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু জ্যোতি হারিয়ে গেছে আমাদের মাঝ থেকে, চিরদিনের জন্য।

তথ্যসূত্র : অপূর্ব শর্মার লেখা ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ বই (সাহিত্য প্রকাশ)।