১৯৭১

চিকিৎসক গোলাম মোস্তফাকে যেভাবে খুন করে পাকিস্তানিরা

Looks like you've blocked notifications!

মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসকল মহান চিকিৎসক শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। ২৩ চৈত্র ১৩৪২ বঙ্গাব্দ, ৫ এপ্রিল ১৯৩৬ সালের কুমিল্লার লাকসামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর গ্রামের নাম ছিল মিছির গ্রাম।

তাঁর পিতা ছিলেন একজন শিক্ষক। মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন গোলাম মোস্তফা। অ্যাথলেটিকস, ছবি আঁকা, সঙ্গীত, সেতার বাদন, রান্নার প্রতি ঝোক তাঁর অনেক। ১৯৫৪ সালে লাকসামের হরিশ্চর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে এলএমএফ ভর্তি হন ১৯৫৮ সালে। এমবিবিএস অসমাপ্ত রেখেই ১৯৫৯ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শাহবাজপুর রুরালে সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে একই পদে ১৯৬৪-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ব্রাক্ষণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর মোগরা রুরাল ডিসপেনসারিতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালের ৩১ অক্টোবর রোশেনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর ১৯৬৬-৬৮ পর্যন্ত সাব-ডিভিশনাল মেডিকেল অফিসার হিসেবে ব্র্হ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন। পদোন্নতি পেয়ে ১৯৬৮-৭০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সাব-ডিভিশনাল মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে এম বি বি এস কনডেন্সড কোর্স করার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে।

১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ায় আর ক্লাস হচ্ছিল না।তাই মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের এম বি বি এস কন্ডেন্সড কোর্সের শেষ বর্ষের ছাত্র ডা. এ কে এম গোলাম মোস্তফা স্ত্রী-কন্যার কাছে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে লালখান বাজারের বাসায়। ৭ মার্চে পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত ভাষণ রেডিওতে শুনে দারুণ উত্তেজিত তিনি। মে মাসে পরীক্ষা হয়ে গেলেই তাঁর এম বি বি এস সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। ‘দেশও স্বাধীন হয়ে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হবো প্রথম ব্যাচের ডাক্তার’ ব্যাকুল আশাবাদ ব্যক্ত করলেন স্ত্রীর কাছে। অত্যন্ত গুণী, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান।

এরপর আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। সারা দেশের মানুষের মতো তিনিও বিভ্রান্ত, শোকার্তা ও ক্ষুব্ধ। ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ম্যাসাকার শুরু করলে আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি; ‘এবারে আর্মি নেমে গেছে। শহরে, রোশেনা, আমরা বোধহয় বাঁচব না’ স্ত্রীকে বললেন।

২৯ মার্চ রাতে পুলিশ লাইন দখল করে নিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রচুর বাঙালি পুলিশ শহীদ হন। এরপর পাকবাহিনীর নজর পড়ে লালখান বাজার এলাকার দিকে। তাঁদের কাছে খবর রয়েছে যে, লালখান বাজার এলাকার লোকজন বাঙালি পুলিশদের সহযোগিতাঁ করেছিল। ৩০ মার্চ সকালবেলায় দেখা গেল আমাদের বাড়িতে এক ফোটাও পানি নেই; খাওয়ার পানির সঙ্কট। শোনা গেল একটু দূরেই হাইলেভেল রোডের মুখে ওয়াসা পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে। ওখানে গেলে যে কেউই পানি আনতে পারবে। ডা. গোলাম মোস্তফার মেজ ভায়রা (ব্যাংক অফ পাকিস্তানের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিককমী) কাজী আলী ইমাম সাহেব ভ্রাতুষ্পপুত্র  আর কাজের ছেলে রাজুকে সাথে নিয়ে পানি আনতে রওনা হলেন।

এদিকে খবর এলো প্রতিবেশী রেলওয়ে অফিসার আর এন বাগচী সাহেব অসুস্থ। তাই ভাক্তার সাহেবকে একটু ডেকে পাঠিয়েছেন। রাস্তায় নেমেই ভায়রার সাথে দেখা হয়ে গেল ডা. গোলাম মোস্তফার। তাঁরা একসাথেই রওনা হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে একশ’ দেড়শ’ গজ এগোতেই হাতের বা দিক থেকে ধোপা পুকুরের পাড় বেয়ে নেমে এলো পাক মিলিটারিরা। ডাক্তার সাহেব খোকন আর রাজুকে ইশারা করলেন পালিয়ে যেতে ।

খোকন দোকানের পেছনে আর রাজু ড্রেনে লুকিয়ে পড়লো। কিন্তু বাকিরা পড়ে গেলেন, পাকসেনাদের সামনে। পাকিস্তানিরা তাঁদের জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কোথায় যচ্ছো?” তাঁরা জানালেন, তাঁরা পানি আনতে যাচ্ছেন। কিন্তু পেছন ঘুরতেই সেখান থেকে দুটি গুলি কাজী আলী ইমাম সাহেবের দিকে ছুটে এলো। পিঠ দিয়ে ঢুকে সেগুলো বুক ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর ডাক্তার সাহেব? জানি না। কী ছিল ঘটনার পর্যায়ক্রম। তাঁর বুকের ডান দিকে একটা গুলির চিহ্ন ছিল যেটা পিঠ ফুটো করে ঢুকে গিয়েছিল, বাইরে বেরোয়নি। গুলির প্রচণ্ড ধাক্কায় বাহয় তিনি সজোরে আশপাশের ইটের ওপর পড়েছিলেন; তাই মাথাটা ফেটে গিয়েছিল। পেটের বা দিকটা হায়েনারা বেয়নেট দিয়ে চিত্রে দিয়েছিল। চর্বি (ওমেনটাম) বেরিয়ে এসেছিল। সেই কাটা দিয়ে। চিৎ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

খোকন বাসায় ফিরে এসে বহু প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল ‘আব্ববুরা ওখানে পড়ে আছে।’ আলী ইমাম সাহেবের মা সালেমা খাতুনের পেছন পেছন বাড়ির মহিলারা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যান। ঘটনাস্থলে। ইতিমধ্যে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা আরো দু-চারজন পথচারী বেরিয়ে এসে তাঁদের লাশ তুলে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। মাত্র ৯ দিন আগে যে বাড়িতে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সে বাড়ির বারান্দাতেই সহকর্তাদের চিরবিদায়ের জন্য শোয়ানো হলো। ঠিক তক্ষুনি আবার এসে হাজির হলো পাক হায়েনার দল। তাঁরা বলল, ‘ফেক দো ড্রেন মে, এ মালাউনকা লাশ হ্যায়।’ কাজী আলী ইমাম সাহেবের বড় ভাই কাজী ইমাম সাহেব বেরিয়ে এসে বাড়ির সব পুরুষ সরিয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বোঝানোর চেষ্টা করেন জয়, ‘তাঁরা হিন্দু নন, তাঁরা মুসলমান।’ তাঁর বুকে বন্দুকের নল ঠেকালো তারা। সালেমা খাতুন ছুটে এসে তাঁদের পায়ে পড়লেন, ‘দুজনকে নিয়েছ তোমরা। আর না।’ রোশেনা বেগমের মেজ বোন জরিনা বেগম ছুটে এসে বন্দুকের নল নিজের বুকে টেনে নেন। এতক্ষণ কোরান শরিফ বুকে নিয়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে স্বামীর পাশে বসেছিলেন কাজী আলী ইমাম সাহেবের স্ত্রী মনি ইমাম।

হঠাৎ তিনি কোরআন শরীফ খুলে পড়তে শরু করলেন। চমকে উঠল পাকিস্তানিরা, ‘কে? কে পড়ে কোরান? তোমরা কোরান পড়? তবে তোমরা হিন্দু নও? কিন্তু আমাদের তো জানানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সবাই হিন্দু।’ হাসান ইমাম সাহেব আবারও তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তাঁরা সুন্নি মুসলমান। তখন তাঁরা বলল, ‘ঠিক আছে, আমাদের ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু লাশ তোমরা আমাদের দিয়ে দাও।’ অনেক অনুনয়ের পর তাঁরা এই মর্মে রাজি হয় যে ‘কেবল রাতের বেলা তোমরা নিজ বাড়িতেই দাফন করতে পার। আর্মিরা চলে যাওয়ার পর ছোট কুহুকে (ড. এ কে এম গোলাম মোস্তফার একমাত্র সন্তান) ডেকে এনে শেষবারের মতো তাঁর আব্বু (ডা. এ কে এম গোলাম মোস্তফা)ও লাল আব্বুর (আলী ইমাম) চেহারা দেখানো হয়। ‘দেখে নে তোর আব্বাদের শেষবারের মতো, আর কোনোদিনও দেখতে পাবি না।’ অবোধ শিশুটি কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল।

ওই দিন সবাই মিলে লাশ দুটিকে ঘিরে বসে রইলেন। সন্ধ্যার পর শুরু হলো কবর খোঁড়ার পালা। চার বোন তাঁদর ফুপু (বড় ও মেজর শাশুড়ি) সালেমা খাতুনসহ বাড়ির সামনের বাগানে কবর খুঁড়তে গেলেন। এর মধ্যে মেজ ও ছোট সদ্য বিধবা ও একজন বৃদ্ধা। কাজ আর এগোয় না। হাসান ইমাম সাহেব কাজের ছেলেটিকে নিয়ে এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে। পালাক্রমে কোদাল ধরে ভোর নাগাদ তৈরি হলো জোড়া কবর। খুব সকালে জানাজা শেষে কবরস্থ করা হলো দেশের দুই সুসন্তানকে।

চট্টগ্রামে  লালখান বাজারের (বাড়িরর সামনের বাগান) ১০ নং হাইলেভেল রোডের পাশে জাতির এই সুর্য সন্তানকে কবরস্থ করা হয়। তাঁর একমাত্র সন্তানের নাম ডা. রোকসানা দিল আফরোজ। চিকিৎসক গোলাম মোস্তফার স্মরণে বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে তাঁর নামে স্মৃতিফলক নিমার্ণ করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র

১। মেডিভয়েস

২। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক (জীবন কোষ)